এক চরম শত্রুর উন্মোচন

ইতিহাসের পাতায় এমন কিছু চরিত্র অমর হয়ে থাকে, যারা সত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কেবল নিজেদের ধ্বংসই ডেকে আনে। ইসলামের প্রথম যুগে এমনই এক প্রবল প্রতিপক্ষ ছিল আবু জাহেল, যার আসল নাম ছিল আমর ইবনে হিশাম। জাহেলী যুগে তাকে ‘আবুল হাকাম’ বা ‘জ্ঞানের পিতা’ উপাধিতে ভূষিত করা হলেও, তার মূর্খতা, অহংকার আর ইসলামের প্রতি চরম শত্রুতার কারণে মহানবী (সা.) তাকে ‘আবু জাহল’ বা ‘মূর্খের পিতা’ নামে অভিহিত করেন। এই প্রবন্ধে আমরা কুরআন ও হাদিসের আলোকে আবু জাহেলের সীমাহীন জুলুম, নবীজির প্রতি তার বিদ্বেষ এবং তার মর্মান্তিক পরিণতির দিকে আলোকপাত করব।

 

নবী (সা.)-এর প্রতি আবু জাহেলের বিদ্বেষ: কুরআনের সতর্কবার্তা

আবু জাহেলের শত্রুতা এতটাই তীব্র ছিল যে, পবিত্র কুরআন স্বয়ং তার আচরণ নিয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে। সূরা আলাকের সেই ঐতিহাসিক আয়াতগুলো, যা নবুওয়াতের প্রথম দিকেই নাযিল হয়েছিল, আবু জাহেলের ঔদ্ধত্যের প্রতি ইঙ্গিত করে:

  • “তুমি কি মনে করো, যদি সে সৎপথে থাকে, অথবা তাকওয়ার নির্দেশ দেয় (তবে তাকে বাধা দেওয়া কি ঠিক)? তুমি লক্ষ্য করেছ কি, যদি সে (রাসূলকে) মিথ্যা মনে করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়?” (সূরা আলাক: ১১-১৩)

এখানে আল্লাহ আবু জাহেলের সেই কর্মের তীব্র নিন্দা করেছেন, যেখানে সে আল্লাহর নবীকে নামাজ আদায় করতে বাধা দিতে চেয়েছিল। তার এই ধৃষ্টতার জবাবে আল্লাহ বলেন:

  • “তবে কি সে অবগত নয় যে, আল্লাহ (তার সবকিছু) দেখছেন? সাবধান! সে যদি নিবৃত্ত না হয় তাহলে আমি (তাকে) অবশ্যই টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যাব, মাথার সামনের চুলের ঝুঁটি ধরে।” (সূরা আলাক: ১৪-১৫)

এই আয়াতগুলোর প্রেক্ষাপটে আবু জাহল একবার গর্ব করে বলেছিল যে, যদি মুহাম্মাদ (সা.) কাবাঘরের কাছে নামাজ পড়া থেকে বিরত না হয়, তবে সে তার ঘাড়ে পা রেখে দেবে। এই কথা যখন নবীজির কানে পৌঁছাল, তিনি বলেছিলেন, “যদি সে তা করত, তাহলে ফিরিশতা তাকে ধরে ফেলতেন।” (সহীহ বুখারী, তাফসীর সূরা আলাক)


 

রাসূল (সা.)-কে আঘাতের দুঃসাহস ও আল্লাহর সুরক্ষা

আবু জাহেল কেবল মুখের কথায় নয়, বাস্তবেও নবীজিকে কষ্ট দেওয়ার জন্য বার বার চেষ্টা করেছে।

একদিন কুরাইশ সরদারদের সামনে আবু জাহল দম্ভভরে বলল, “মুহাম্মাদ কি আপনাদের সামনে নিজের চেহারায় ধূলো লাগিয়ে রাখে?” (অর্থাৎ সিজদা করে) যখন তারা হ্যাঁ বলল, তখন সে কসম করে বলল, “যদি আমি তাকে এই অবস্থায় দেখি, তবে তার ঘাড় ভেঙ্গে দেব, তার চেহারা মাটিতে হেঁচড়াব!” এরপর রাসূল (সা.)-কে নামাজ আদায় করতে দেখে সে এগিয়ে গেল। কিন্তু সকলে অবাক হয়ে দেখল, আবু জাহল হঠাৎ চিৎপটাং হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে এবং চিৎকার করে বলছে, “বাঁচাও বাঁচাও!” তার পরিচিতরা জিজ্ঞেস করলে সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আমি দেখলাম, আমার ও মুহাম্মাদের মধ্যখানে আগুনের একটি পরিখা। ভয়ংকর সে আগুনের পরিখায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে।” নবীজি (সা.) এ কথা শুনে বললেন, “যদি সে আমার কাছে আসত, তবে ফেরেশতা তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিঁড়ে ফেলত।” ([১৭] সহীহ বুখারী)

আরেকবার সে কুরাইশদের বলল, “মুহাম্মাদ আমাদের ধর্মের সমালোচনা ও উপাস্যদের নিন্দা থেকে বিরত হচ্ছে না।” এরপর সে একটি ভারী পাথর নিয়ে বসে রইল এই প্রতিজ্ঞা করে যে, রাসূল (সা.) সিজদায় গেলে সে পাথর দিয়ে তার মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবে। রাসূল (সা.) যথারীতি নামাজ শুরু করলেন এবং যখন সিজদায় গেলেন, আবু জাহল পাথর নিয়ে অগ্রসর হলো। কিন্তু পরক্ষণেই ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় ফিরে এলো, যেন তার হাত পাথরের সাথে আটকে গেছে। সে বলল, “আমি যে কথা রাতে বলেছিলাম, তা করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পৌঁছাতেই দেখতে পেলাম, মুহাম্মাদ এবং আমার মাঝখানে একটা উট এসে দাঁড়িয়েছে। আল্লাহর কসম! অত বড় লম্বা ঘাড় ও দাঁতবিশিষ্ট উট আমি কখনো দেখিনি। উটটি আমাকে হামলা করতে অগ্রসর হচ্ছিল।” এ ব্যাপারে রাসূল (সা.) বলেছেন, “উটের ছদ্মবেশে ছিলেন জিবরীল (আঃ)। আবু জাহল যদি কাছে আসত, তবে তাকে পাকড়াও করা হতো।” ([১৮] সহীহ মুসলিম)

শুধু তাই নয়, একবার আবু জাহেল সাফা পাহাড়ের কাছে রাসূল (সা.)-কে গালমন্দ করে এবং তার মাথায় পাথর নিক্ষেপ করে রক্তাক্ত করে। এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করে আব্দুল্লাহ ইবনে জুদ’য়ানের এক দাসী। ঘটনাটি জানতে পেরে কুরাইশদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী যুবক হামযাহ (রা.) ক্রোধে অস্থির হয়ে উঠলেন। তিনি সোজা কা’বা ঘরে গিয়ে আবু জাহেলের সামনে দাঁড়ালেন এবং বললেন, “ওরে গুহ্যদ্বার দিয়ে বায়ু ত্যাগকারী! তুই আমার ভাতিজাকে গালি দিয়েছিস, অথচ আমিও তার প্রচারিত দ্বীনের অনুসারী?” এ কথা বলেই হাতের ধনুক দিয়ে আবু জাহেলের মাথায় এমন জোরে আঘাত করলেন যে, তার মাথায় বড় ধরনের জখম হয়ে গেল। এই ঘটনার পর আবু জাহল তার গোত্রকে থামিয়ে দিল, স্বীকার করে নিল যে সে সত্যিই খারাপ ভাষায় গালি দিয়েছিল। ([১৯, ২০] সিরাত ইবনে হিশাম)


 

ইয়াসির পরিবারের উপর নৃশংসতা: ইসলামের প্রথম শহীদগণ

আবু জাহেলের বর্বরতা কেবল নবীজি (সা.)-এর উপর সীমাবদ্ধ ছিল না, দুর্বল ও অসহায় মুসলিমদের উপরও সে চালিয়েছিল অমানুষিক নির্যাতন। ইয়াসির (রা.) এবং তার স্ত্রী সুমাইয়া (রা.) ও তাদের পুত্র আম্মার (রা.) মুসলমান হওয়ার কারণে বনু মাখযূমের এই ক্রীতদাস পরিবারটির উপর নেমে আসে নৃশংসতম শাস্তি। আবু জাহলের নির্দেশে তাদেরকে খোলা ময়দানে উত্তপ্ত বালুকার উপরে ফেলে রেখে নানাভাবে নির্যাতন করা হতো।

একদিন তাদের এই শাস্তির দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “ধৈর্য ধর হে ইয়াসির পরিবার! তোমাদের ঠিকানা হলো জান্নাত।” ইয়াসির (রা.)-এর দুই পায়ে রশি বেঁধে দুটি উটের পায়ে বেঁধে দেওয়া হয়, এরপর উট দুটিকে দুই দিকে জোরে হাঁকিয়ে নেওয়া হয়। এতে হেঁচকা টানে ইয়াসির (রা.)-এর দেহ দ্বিখন্ডিত হয়ে যায় এবং সেখানেই তিনি শাহাদতবরণ করেন। তিনিই ছিলেন ইসলামের প্রথম পুরুষ শহীদ।

এরপর পাষাণ হৃদয় আবু জাহল নিজ হাতে সুমাইয়া (রা.)-এর গুপ্তাঙ্গে বর্শা বিদ্ধ করে তাকে হত্যা করে। তিনিই ছিলেন ইসলামের প্রথম মহিলা শহীদ।

তাদের একমাত্র পুত্র আম্মার (রা.)-এর উপর শুরু হয় অবর্ণনীয় নির্যাতনের পালা। তাকে উত্তপ্ত কংকরময় বালুর উপর হাত-পা বেঁধে পাথর চাপা দিয়ে ফেলে রাখা হয়। একদিন তাকে পানিতে চুবিয়ে আধামরা অবস্থায় উঠিয়ে বলা হলো, “তুমি যতক্ষণ মুহাম্মাদকে গালি না দিবে এবং লাত, মানাত ও উযযা দেব-দেবীর প্রশংসা না করবে, ততক্ষণ তোমাকে মুক্তি দেওয়া হবে না।” অবশেষে বাধ্য হয়ে তিনি তাদের কথা মেনে নেন। পরেই তিনি রাসূল (সা.)-এর দরবারে গিয়ে কান্না-জড়িত কণ্ঠে সব ঘটনা খুলে বললেন ও আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। তখন নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়:

  • “ঈমান আনার পরে যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কুফরী করে তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর ক্রোধ এবং কঠিন শাস্তি। কিন্তু যাকে বাধ্য করা হয়, অথচ তার অন্তর বিশ্বাসে অটল থাকে (তার জন্য কোনো চিন্তা নেই)।” (সূরা আন-নাহল: ১৬/১০৬)

পরবর্তীতে আবু বকর (রা.) আম্মার বিন ইয়াসিরকে তার মনিবের কাছ থেকে খরিদ করে মুক্ত করে দেন। ([২১, ২২] সিরাত ইবনে হিশাম, তাবাকাত ইবনে সাদ)


 

বদর প্রান্তরে আবু জাহেলের শেষ পরিণতি: ফিরাউনের পতন

রাসূল (সা.) ও তার সাথীদের উপর আবু জাহেলের সীমাহীন অত্যাচার ও জুলুমের চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে বদর প্রান্তরে। এই ঐতিহাসিক যুদ্ধে আবু জাহেল যা কল্পনাও করতে পারেনি, তাই সংঘটিত হলো। মুসলিম মুজাহিদদের প্রচণ্ড হামলায় তার সুরক্ষিত প্রহরা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।

আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) বর্ণনা করেন, বদর যুদ্ধের দিনে তিনি মুসলিমদের কাতারে ছিলেন। হঠাৎ তার ডানে ও বামে দু’জন আনসার কিশোরকে দেখতে পেলেন। তাদের উপস্থিতি নিয়ে তিনি ভাবছিলেন, যখন একজন চুপিসারে বলল, “চাচাজান! আবু জাহল কে? আমাকে দেখিয়ে দিন।” আব্দুর রহমান (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি তার কী করবে?” কিশোরটি বলল, “আমি শুনেছি সে নবী করীম (সা.)-কে গালি দিয়ে কষ্ট দেয়। সেই সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ, যতক্ষণ পর্যন্ত আমার জীবন থাকে ততক্ষণ আমি তার সাথে লড়াই করে যাব।” কিছুক্ষণ পর তিনি আবু জাহলকে দেখতে পেয়ে কিশোরদ্বয়কে দেখিয়ে দিলেন। তারা দ্রুত আবু জাহলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং তাকে হত্যা করে ফেলল।

তারা ছিলেন মু’আয ইবনে আমর ইবনে জামূহ এবং মু’আবিবয ইবনে আফরা (রা.)। তাদের তলোয়ারে আবু জাহেলের জীবনের ইতি ঘটলো। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের তলোয়ার পরীক্ষা করে নিশ্চিত করলেন যে, উভয়েই তাকে হত্যা করেছে। এরপর নবীজি (সা.) বললেন, “চলো আমাকে তার লাশ দেখাও।” যখন তারা আবু জাহলের লাশের কাছে পৌঁছালেন, রাসূল (সা.) বললেন, “এ হচ্ছে এই উম্মাতের ফেরাঊন।” ([২৩, ২৪] সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম)

আব্দুল্লাহ ইবনে মাস’উদ (রা.) আরও বর্ণনা করেন, একবার আবু জাহল ও তার সাথীরা বায়তুল্লাহর পাশে বসেছিল, যখন রাসূল (সা.) নামাজ আদায় করছিলেন। তাদের নির্দেশে উটের ভুড়ি এনে সিজদারত রাসূল (সা.)-এর দুই কাঁধের মাঝখানে চাপিয়ে দেওয়া হলো। ইবনে মাস’উদ (রা.) সব দেখছিলেন কিন্তু অসহায় ছিলেন। শত্রুরা দানবীয় উল্লাসে ফেটে পড়ছিল। এই দুঃসংবাদ ফাতেমা (রা.)-এর কানে পৌঁছালে তিনি দৌঁড়ে এসে ভুড়িটি সরিয়ে দিয়ে পিতাকে রক্ষা করেন। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) মাথা উঁচু করে তিনবার বলেন, “হে আল্লাহ! তুমি কুরাইশকে ধরো (তিনবার)! হে আল্লাহ! তুমি আমর ইবনে হিশাম অর্থাৎ আবু জাহলকে ধরো। হে আল্লাহ! তুমি উৎবা ও শায়বাহ বিন রাবী’আহ, ওয়ালীদ বিন উৎবা, উমাইয়া বিন খালাফ, ওক্ববা বিন আবী মু’ঈত্ব এবং ওমারাহ বিন ওয়ালীদকে ধরো।” ইবনে মাস’উদ (রা.) বলেন, “আমি তাদের (উক্ত ৭ জনের) সবাইকে বদর যুদ্ধে নিহত হয়ে কূয়ায় নিক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখেছি।” ([২৫] সহীহ বুখারী)


 

সত্যের জয় ও জুলুমের পতন

আবু জাহেলের ঘটনা ইসলামের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। এটি প্রমাণ করে যে, সত্যের বিরুদ্ধে যেকোনো জুলুম ও ঔদ্ধত্যের পরিণতি হয় ভয়াবহ। আল্লাহ তা’আলা তাঁর নবী ও মুমিন বান্দাদের সর্বদা রক্ষা করেন এবং জালেমদের শেষ পর্যন্ত পাকড়াও করেন। আবু জাহেলের পতন যেমন একদিকে ইসলামের বিজয়ের প্রতীক, তেমনি অন্যদিকে যারা আল্লাহর পথ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং জুলুমের পথ বেছে নেয়, তাদের জন্য এক কঠোর সতর্কবার্তা।

 


কুরআনের গল্পগুলি দ্বারা অনুপ্রাণিত হন, আল্লাহর সাথে আপনার সংযোগকে শক্তিশালী করুন। কঠিন পরিস্থিতি সুন্দরভাবে পরিচালনা করার জন্য মনকে বিকশিত করুন। প্রাসঙ্গিগ আল-কুরআনুল করীম এর  সূরাঃ আর রুম,  পুরো সুরাটি পড়তে Bangla Quran

ফেসবুকে যারা মন্তব্য করেছেনঃ

(Visited ২১৬ times, ১ visits today)