তালাক শব্দটি আমাদের সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ অর্থে প্রচলিত। আল কুরআনে তালাকের যে বিধি-বিধান দেয়া হয়েছে তাতে তালাক শুধুমাত্র মুখে উচ্চারণের কোনো বিষয় নয় বরং এটি একটি আইনগত প্রক্রিয়া। তালাক সম্পর্কে আমাদের সমাজে আল কুরআনের আলোকে সঠিক উপলব্ধির অভাবে এ সম্পর্কিত বিধি-বিধান যথাযথভাবে পরিপালন করা হয় না। ফলে তালাক সংক্রান্ত ব্যাপক পারিবারিক ও সামাজিক সংকটের সৃষ্টি হয়। আল কুরআনের আলোকে তালাকের বিধি-বিধান সম্পর্কে আলোকপাত করে বিশ^প্রভুর বিধান জানা ও মানার অনুপ্রেরণা এবং এর মাধ্যমে ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণের উপায় অবলম্বনের উদ্দেশ্যে বইটি রচনা করা হয়েছে।
তালাক একটি সামাজিক ও আইনগত বিষয় হওয়ায় বইটি রচিত হয়েছে সমাজকর্মী, আইনজ্ঞ, আইন বিভাগের অধ্যাপক ও অধ্যয়নশীল শিক্ষার্থীবৃন্দ, আইনজীবি, নারী অধিকার বিষয়ে কর্মরত বিভিন্ন সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি, আইন প্রণয়নে সম্পৃক্ত মাননীয় সংসদ সদস্য ও সচিববৃন্দ এবং যারা বিষয়টি জানতে ও তার ভিত্তিতে সমাজ কল্যাণে ভূমিকা রাখতে আগ্রহী এবং সেই সাথে যেসব নারী-পুরুষ সংসার জীবনে কোনো তিক্ততার কারণে তালাকের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন এমন সকলের জন্য।
আল কুরআন অনুসারে মু’মিনরা তাদের কার্যক্রমে (তথা কুরআনে বর্ণিত বিধি-বিধান অনুধাবন ও অনুশীলন এবং বিভিন্ন নির্বাহী সিদ্ধান্ত গ্রহণ – এ দ্বিবিধ ক্ষেত্রে) পরামর্শ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে (৪২:৩৮)। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বইটিকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একটি বিশ্লেষণাত্মক ধারা বিবরনী হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। এছাড়া বইটি কুরআনের বিধি-বিধানের যৌক্তিকতা বিষয়ে একটি সাক্ষ্য। যারা এ বিষয়ে পারস্পরিক উপলব্ধির শেয়ারকে অনুধাবন যোগ্যতা উন্নয়নের কার্যকর উপায় হিসেবে অবলম্বনের স্তরে রয়েছেন বইটি তাদের কাজে আসতে পারে। বইটিতে উল্লেখিত আয়াতসমূহ মহান আল্লাহর নাজিলকৃত শাশ^ত সত্যের ধারক। লেখকের আলোচনার অংশটি অবশ্যই আল কুরআনের আয়াতসমূহের দ্বারা যাচাইযোগ্য এবং সেই সাথে যদি কোথাও বিশ্লেষণগত ত্রুটি ধরা পড়ে তাহলে পরবর্তী সংস্করণে সংশোধনযোগ্য।
এক নজরে মূল প্রতিপাদ্য
১. ‘তালাক’ শব্দটি উচ্চারণের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায় বলে ধারণা করা হয়। অথচ কুরআনের বিধান অনুযায়ী তালাকের সাথে সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ হয় না। বরং হঠকারী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দ্রুত বিবাহ বিচ্ছেদকে সুস্পষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তালাক কার্যকর করতে হবে ইদ্দাতের (সুনির্দিষ্ট অপেক্ষার সময়) শর্ত পূরণ করে। ইদ্দাত অতিবাহিত হবার পর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়, একে মুফারাক্বাত বলা হয়।
২. আমাদের সমাজে ‘তিন তালাক’ শব্দটি অত্যন্ত পরিচিত। অথচ কুরআনে স্বাভাবিক তালাকের সংখ্যা হিসেবে ‘আত তালাক্বু মাররাতান’ বা ‘তালাক দুইবার’ কথাটি বলা হয়েছে যার পরে স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে সম্মত হলে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উৎসাহ ও অনুমোদন কুরআনে রয়েছে। এরপরে তৃতীয়বার তালাক হচ্ছে অস্বাভাবিক তালাক যার পর বিশেষ শর্ত পূরণ ছাড়া তালাকপ্রাপ্তাকে ফিরিয়ে নেয়ার সুযোগ থাকে না।
৩. তালাক নিছক শব্দ উচ্চারণের বিষয় নয় বরং তালাক হচ্ছে একটি প্রক্রিয়া। দুজন ন্যায়পরায়ণ স্বাক্ষী রেখে ইদ্দাতের বিধি বিধানের দিকে লক্ষ্য রেখে তালাক কার্যকর করতে হবে। এছাড়া তালাকের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার আগে মীমাংসার উদ্যোগ নিতে স্বামীর পরিবারের একজন ও স্ত্রীর পরিবারের একজন বিচক্ষণ সালিশদার নিযুক্ত করতে হবে।
৪. সাধারণত মনে করা হয় যে, দুইবার বা তিনবার তালাক দিতে হবে। অথচ বাস্তবে একবার তালাক দিলেই তাতে তালাক হয়ে যায়। স্বাভাবিক তালাক দুইবার কথাটির অর্থ দুইবার তালাক দিতে হবে এমন নয়।
৫. প্রচলিত হিল্লা বিয়ে একটি কুরআন পরিপন্থী কুপ্রথা। এর মাধ্যমে আল্লাহর আয়াতকে হাসি তামাশার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। প্রচলিত হিল্লা বিয়ে আল কুরআন অনুসারে সম্পূর্ণ অবৈধ।
৬. ইদ্দাতকালে স্ত্রীকে স্বামীর সমান মানসম্পন্ন গৃহে রাখতে হবে, সাধ্যমতো স্ত্রীর ভরণপোষণ দিতে হবে, স্ত্রীকে দেয়া মোহরানার কোনো অংশ ফেরত নেয়া যাবে না এবং ইদ্দাতশেষে স্ত্রীকে উত্তমভাবে সাধ্যমতো কিছু ভোগসামগ্রী দিয়ে বিদায় দিতে হবে।
৭. স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে তালাক দিতে পারে এবং সেক্ষেত্রে ফিদইয়াস্বরূপ দেনমোহরের কিছু অংশ ফেরত দিতে হয়। এছাড়া স্ত্রীর স্পষ্ট অশ্লীলতার কারণে তালাক দিলে সেক্ষেত্রেও স্বামী ক্ষতিপূরণ হিসাবে দেনমোহরের কিছু অংশ ফেরত পেতে পারে।
৮. কুরআনে পারিবারিক সহিংসতার কোন স্থান নেই। আয়াতের ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে অনেকে তালাক সর্ম্পকিত আয়াতে ব্যবহৃত ‘ওয়াদরিবূহুন্না’ (তাদেরকে দরবুন করো) এর অর্থ করে থাকেন আঘাত বা মৃদু আঘাত করা, যা এখানের কনটেক্সট বা পরিপ্রেক্ষিত ও আইনী প্রয়োগের পরিপন্থী। বরং বিশ্লেষণে ‘ওয়াদরিবূহুন্না’ অর্থ ‘তাদেরকে আঘাত / প্রহার করো’ হতে পারে না বরং সাধারণভাবে কোন ব্যক্তিকে দরাবা করার অর্থ হচ্ছে তাকে তথা তার সাথে সম্পর্কিত বিষয়কে সামনে উপস্থাপন করা।
৯. ‘যিহার’ কে অবৈধ করার মাধ্যমে কার্যত হঠকারী আচরণস্বরূপ কেবলমাত্র মুখে উচ্চারণ করে তালাক কার্যকরের যেকোনো প্রচলন অবৈধ করা হয়েছে।
১০. লিআনের শিক্ষা এই যে স্বামী তার স্ত্রীকে ব্যভিচারের দায়ে দায়ী করলে স্বাক্ষী না থাকলে স্ত্রীর স্বাক্ষ্যই অগ্রাধিকার পাবে।