জন্ম
মুহাম্মদ (সা.) আরবের মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা আমিনাহ, যুহরাহ গোত্রের ওহ্ব ইবনে আবদ মানাফ-এর কন্যা ছিলেন। তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ ছিলেন আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র। তাঁর বংশধারা প্রায় চল্লিশটি ধাপে পৌঁছেছে নবী ইব্রাহিম (আঃ)-এর পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-এর সম্মানিত বংশ পর্যন্ত।
মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মের আগেই তাঁর পিতা ইন্তিকাল করেন, আর কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁর মাতাও ইন্তিকাল করেন। ফলে তিনি খুব ছোট বয়সেই এতিম হয়ে যান।
মক্কার সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোর প্রথা অনুযায়ী, তাঁর শৈশব কাটে এক দূরবর্তী গ্রামে এক দুধ-মায়ের কাছে। তিনি দুধ-মাতা হালিমার সঙ্গেই কয়েক বছর ছিলেন। এ সময়ে তাঁকে মাঝে মাঝে মক্কায় তাঁর মাতার সাথে দেখা করাতে আনা হতো। তাঁর মা মারা যাওয়ার পর তাঁকে দায়িত্ব নেন দাদা আব্দুল মুত্তালিব। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে দাদাও ইন্তিকাল করলে তিনি চাচা আবু তালিবের হেফাজতে চলে যান। সেই সময় তিনি মক্কার আশপাশে পশুপালনের কাজ করতেন এবং চাচার সঙ্গে সিরিয়ার বাণিজ্য সফরেও অংশ নিতেন।
যৌবন
শৈশব থেকেই তিনি এক আল্লাহর ওপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখতেন। তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল জীবনযাপন করতেন এবং অহংকার ও গর্বকে ঘৃণা করতেন। তিনি গরীব, বিধবা ও এতিমদের প্রতি ছিলেন দয়ালু ও সহানুভূতিশীল। তিনি তাদের দুঃখ-কষ্টে শরিক হতেন এবং সাহায্য করতেন।
তাঁর যুগের তরুণদের মধ্যে প্রচলিত ছিল নানা অনৈতিক কাজ—যেমন জুয়া খেলা, মদ পান, অশ্লীলতা ইত্যাদি—কিন্তু মুহাম্মদ (সা.) এসব কাজ থেকে সম্পূর্ণ বিরত ছিলেন।
লোকেরা তাঁকে ডাকত “আস-সাদ্দিক” (সত্যবাদী) এবং “আল-আমিন” (বিশ্বস্ত)। বিভিন্ন বিবাদমান দলের মধ্যে সালিশ বা মধ্যস্থতা করার জন্য তাঁকে সবসময় বিশ্বাস করা হতো।
বিবাহ
যখন মুহাম্মদ (সা.) প্রায় ২৫ বছর বয়সে পৌঁছান, তখন তাঁর চাচা তাঁকে পরামর্শ দেন একটি কাফেলার সাথে কাজ করতে, যা ছিল একজন ধনী বিধবা খাদিজা (রাঃ)-এর মালিকানাধীন। তিনি প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন এবং সিরিয়ার উদ্দেশ্যে বাণিজ্য সফরে যান। অত্যন্ত সততা, বিচক্ষণতা ও দায়িত্ববোধের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করেন, যার ফলে সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি লাভ নিয়ে ফিরে আসেন।
খাদিজা (রাঃ) মুহাম্মদ (সা.)-এর সততা ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে এতটাই মুগ্ধ হন যে, তিনিই বিবাহের প্রস্তাব দেন, যা মুহাম্মদ (সা.) গ্রহণ করেন। তাঁদের এই বিবাহ ছিল অত্যন্ত সুখের। তাঁদের সন্তানও হয়েছিল। খাদিজা (রাঃ) তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত, ৬৫ বছর বয়সে, মুহাম্মদ (সা.)-এর একমাত্র স্ত্রী ছিলেন।
নবুওয়ত প্রাপ্তি
মুহাম্মদ (সা.) এমন এক সমাজে জন্মগ্রহণ করেন যেখানে বহু মূর্তির উপাসনা করা হতো (বহু ঈশ্বরের পূজা)। এই অবনত ও ভ্রষ্ট সমাজব্যবস্থা দেখে তিনি খুব ব্যথিত হতেন। তিনি মক্কার কাছের একটি পাহাড়ের গুহায়, যার নাম ছিল গারে হিরা (পরে “জাবাল আন-নূর” বা “আলো’র পাহাড়” নামে পরিচিত), প্রায়শ ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। সেখানে তিনি অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ ও মানবতার দুরবস্থা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতেন এবং সকল সৃষ্টির মহান স্রষ্টা, অদৃশ্য কিন্তু সর্বত্র বিরাজমান আল্লাহর সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ স্থাপন করতেন।
এক রাতে, যখন তিনি ঐ গুহায় ধ্যান করছিলেন, তখন ফেরেশতা জিবরাইল (আঃ) তাঁর কাছে আসেন। ফেরেশতা তাঁকে জাগিয়ে তোলেন এবং তাঁর বজ্রকণ্ঠ মুহাম্মদ (সা.)-এর কানে ধ্বনিত হয়।
জিবরাইল (আঃ) আদেশ করেন:
“পড়ো!”
মুহাম্মদ (সা.) বিভ্রান্ত হন এবং কী করবেন বুঝে উঠতে পারেন না। তিনি বলেন:
“আমি পড়তে পারি না।”
জিবরাইল আবার আদেশ করেন:
“পড়ো!”
তিনি আবার বলেন:
“আমি পাঠ করতে পারি না।”
তৃতীয়বার জিবরাইল বললেন:
“পড়ো!”
মুহাম্মদ (সা.) উত্তর দেন:
“আমি নিরক্ষর।”
এরপর জিবরাইল (আঃ) তাঁর প্রতি আল্লাহর প্রথম ওহির আয়াত তেলাওয়াত করেন, যা একটি ২৩ বছরের ওহির সূচনা ছিল এবং তা সমগ্র মানবজাতির জন্য ছিল:
“পড়ো তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন—তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্ত থেকে। পড়ো, আর তোমার প্রতিপালক পরম দয়ালু—তিনি কলমের দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন, তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না।”
(সূরা আল-আলাক ৯৬:১–৫)
এটাই ছিল মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি প্রথম ওহি। তখন তাঁর বয়স ছিল ৪০ বছর। এরপর ২৩ বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে তাঁর ওপর ওহি অব্যাহত থাকে।
এই ধারাবাহিক ওহিগুলো আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট বিন্যাসে সাজানো হয় এবং পরবর্তীতে তা একটি কিতাব আকারে সংকলিত হয়—যার নাম আল-কুরআন (অর্থ: তিলাওয়াত/পাঠ)।
এই কুরআনের অধিকাংশ আয়াত স্পষ্ট অর্থবোধক। কিছু আয়াতের ব্যাখ্যা অন্য আয়াতের মাধ্যমে করা হয়েছে, আবার কিছু ব্যাখ্যা স্বয়ং নবী মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বাণী, কর্ম এবং মৌন সম্মতির মাধ্যমে করেছেন—যা সুন্নাহ নামে পরিচিত।
আল-কুরআন এবং সুন্নাহ মিলেই একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। যারা এই জীবনব্যবস্থাকে অনুসরণ করে, আল্লাহ তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে মুক্তির নিশ্চয়তা দিয়েছেন।
বাঁধা সমূহ
যখন রাসূল (সা.) আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বান করতে শুরু করেন, তখন খুব কম লোকই তাঁর ডাকে সাড়া দেয়। যারা সাড়া দেন, তাদের অধিকাংশই ছিলেন তাঁর পরিবারবর্গ কিংবা সমাজের নিম্নস্তরের মানুষ। তাঁদের মধ্যে ছিলেন খাদিজা (রাঃ), আলী (রাঃ), যায়েদ (রাঃ), বিলাল (রাঃ) প্রমুখ।
যখন তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করেন, তখন অনেকেই তাঁর অনুসারী হন; তবে একসঙ্গে শুরু হয় প্রবল বিরোধিতা। মক্কার অভিজাত ও নেতা-স্থানীয়রা নিজেদের প্রভাব খর্ব হবে ভেবে আতঙ্কিত হয়। তাই তারা “পূর্বপুরুষদের ধর্ম রক্ষার” অজুহাতে নতুন ধর্মের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়।
তবে মুসলমানদের মনোবল বৃদ্ধি পায় যখন মক্কার কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: উসমান ইবনে আফফান, যুবাইর ইবনে আওয়াম, আবদুর রহমান ইবনে আওফ, তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ, সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, আরকাম ইবনে আবি আরকাম, উবাইদুল্লাহ, সাঈদ ইবনে যায়েদ, আমর ইবনে নুফায়েল, ফাতিমা (নুফায়েলের স্ত্রী), আসমা বিনতে আবু বকর, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, জাফর ইবনে আবি তালিব এবং আরও অনেকে।
এর আগেই আবু বকর (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেন, যাঁর প্রতি রাসূল (সা.) অত্যন্ত সন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি বলেছিলেন:
“আমি কাউকে ইসলাম দাওয়াত দিলে, সে একটু হলেও চিন্তা করত। কিন্তু আবু বকর ব্যতিক্রম ছিলেন। আমি যখন তাঁকে ইসলামের আহ্বান করলাম, তিনি বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করলেন।”
মক্কার কাফিরদের বিরোধিতার ফলে মুসলমানরা চরম নির্যাতন, নিপীড়ন, সমাজচ্যুতি ও অবরোধের মুখে পড়েন। রাসূল (সা.) ধৈর্যধারণ করেন এবং মুসলমানদের রক্ষা করার পথ খুঁজতে থাকেন। তিনি ইথিওপিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশির কাছে অনুরোধ করেন, যেন মুসলমানরা সেখানে হিজরত করতে পারে। নাজ্জাশি তাঁদের স্বাগত জানান এবং মক্কার অবিশ্বাসীদের কাছে তাঁদের ফিরিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানান।
হিজরত (উপনিবেশ স্থাপন)
মক্কী জীবনের শেষ দিকে রাসূল (সা.) তাঁর প্রিয় দুই ব্যক্তি—চাচা আবু তালিব এবং স্ত্রী খাদিজা (রাঃ)—কে হারান। তাঁদের মৃত্যু মক্কার কাফিরদের জন্য সুযোগ হয়ে দাঁড়ায়, তাঁরা রাসূল (সা.) ও মুসলমানদের ওপর অবাধে নির্যাতন শুরু করে।
মক্কা তখন ছিল বাইতুল্লাহ বা কাবা ঘরের শহর, যেটি নবী ইব্রাহিম (আঃ) বহু পূর্বে তাওহীদের ঘর হিসেবে নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুশরিকরা সেখানে বহু মূর্তি বসিয়ে তা মূর্তিপূজার কেন্দ্রে পরিণত করে। কাবাকে ঘিরে প্রতিবছর আরবের বিভিন্ন গোত্র থেকে হাজার হাজার মানুষ হজের নামে মেলায় যোগ দিত।
রাসূল (সা.) এই সুযোগে ইসলাম প্রচার করতেন। এমন এক সময়ে ইয়াসরিব (পরবর্তীতে মদীনা নামে পরিচিত) থেকে কিছু প্রতিনিধি এসে গোপনে আকাবা নামক স্থানে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা মুসলমান হন এবং ইসলামের, রাসূলের ও মক্কার মুসলমানদের রক্ষার অঙ্গীকার করেন।
পরের বছর তারা আবার আসে এবং পূর্বের স্থানেই রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে দেখা করে। এবার রাসূলের চাচা আব্বাস (যিনি তখনো মুসলমান হননি) উপস্থিত ছিলেন। ইয়াসরিববাসীরা রাসূল (সা.)-কে মদীনায় হিজরতের আমন্ত্রণ জানান এবং মুসলমানদের ভাইয়ের মতো সম্মান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। দীর্ঘ আলোচনা শেষে রাসূল (সা.) হিজরতের সিদ্ধান্ত নেন।
যখন মক্কার কাফিররা মুসলমানদের হিজরতের পরিকল্পনার কথা জানতে পারে, তখন তারা তা ঠেকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু প্রথমদল ইতোমধ্যে হিজরত সম্পন্ন করে। মক্কার নেতারা বুঝতে পারে, ইয়াসরিবে মুসলমানদের ঘাঁটি গড়ে উঠলে ইসলাম আরও শক্তিশালী হবে। তাই তারা রাসূলকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু আল্লাহ তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন। বিচক্ষণ কৌশল ও আল্লাহর সাহায্যে রাসূল (সা.) নিরাপদে মদীনায় পৌঁছান। এরপর শহরটি পরিচিত হয় “মদীনাতুন নবী” (নবীর নগরী) নামে।
একটি নতুন যুগ
মদীনায় রাসূল (সা.) ইসলাম প্রচারের পূর্ণ স্বাধীনতা পান। মুসলমানদের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়তে থাকে। তবে মক্কার দিক থেকে হুমকি অব্যাহত ছিল। মুসলমান ও মক্কার কাফিরদের মধ্যে কয়েকটি যুদ্ধ হয়—কখনো মুসলমানরা বিজয়ী হন, কখনো পরাজিত।
রাসূল (সা.) বাইজেন্টাইন ও পারস্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধেও কিছু অভিযান পরিচালনা করেন, কারণ সেসব শক্তি ইসলামের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলছিল।
হুদাইবিয়ার সন্ধি সম্পাদিত হওয়ার পর মক্কার সঙ্গে যুদ্ধ কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হয়।
মদিনা পর্বে মুসলমানরা মদিনার ইহুদি সম্প্রদায় ও পার্শ্ববর্তী গোত্রগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে। কিন্তু ইহুদিরা চুক্তি ভঙ্গ করলে তাদের আরব উপদ্বীপ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এই সময়ে রাসূল (সা.) ইসলামকে শুধু ইবাদতের দিক থেকেই নয়, বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।
মদীনায় দূতদের আগমন
মদীনায় অবস্থানকালে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে বিভিন্ন গোত্র ও জাতির পক্ষ থেকে দূত ও প্রতিনিধি দল আসতে শুরু করে। তারা বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর জানতে, আলোচনা ও চুক্তি করতে এবং আরও নানান কারণে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করত।
এইসব প্রতিনিধি দলের মধ্যে ছিল দক্ষিণ আরবের নাজরানের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের একটি দলও। নবী (সা.) তাদের সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করেন, মেহমানদারি করেন এবং এমনকি তাদের নিজস্ব ধর্মীয় উপাসনা মদীনাতেই করার অনুমতিও দেন।
এই ঘটনাটি ছিল পারস্পরিক ধর্মীয় মত বিনিময়ের একটি অনন্য সুযোগ। এই প্রতিনিধিদের মধ্যে কয়েকজন মুসলমানদের আচরণে এতটাই মুগ্ধ হন যে তারা ইসলাম গ্রহণ করেন।
মক্কার বিজয়
হুদাইবিয়ার সন্ধি মুসলমানদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ এনে দেয়—তারা নিজেদের ব্যক্তিগত আচরণ ও অন্যান্য জাতি ও সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্কের মাধ্যমে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা তুলে ধরতে সক্ষম হয়। কিন্তু এই শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, কারণ মক্কার কুরাইশ নেতা দলীয় স্বার্থে অচিরেই সেই সন্ধি ভঙ্গ করে।
অবশেষে হিজরতের অষ্টম বছরে, নবী মুহাম্মদ (সা.) গোপনে ও নিরবভাবে একটি বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কার দিকে অগ্রসর হন। মক্কার জনগণ কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলে না এবং সম্পূর্ণ শহর বিনা রক্তপাতে আত্মসমর্পণ করে।
নবী (সা.) সেদিন তাঁর শত্রুদের জন্য একটি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন এবং শহরের সকল অধিবাসীদের প্রতি উদারতা ও সৌজন্যের পরিচয় দেন। এই মহৎ ঘটনার সময় একটি কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হয়:
“যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য এবং বিজয়,
এবং তুমি দেখতে পাবে, মানুষ দলে দলে আল্লাহর ধর্মে প্রবেশ করছে,
তখন তোমার প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা করো এবং তাঁর নিকট ক্ষমা চাও। নিশ্চয়ই তিনি তওবা কবুলকারী।”
(সূরা আন-নাসর, আয়াত ১-৩)
মক্কা বিজয়ের পর আরব উপদ্বীপের সকল বিদ্রোহী ও শত্রুতাপূর্ণ গোত্রগুলো ইসলামের সত্যতা ও শক্তির বাস্তব উপলব্ধি করতে শুরু করে। তারা ইসলামের উদারতা, ন্যায়বিচার, সহনশীলতা, ধৈর্য এবং ক্ষমাশীলতা নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করে।
নবী (সা.) এবং তাঁর সাহাবীদের উদাহরণ দেখে হাজার হাজার মানুষের হৃদয়ে ইসলামের প্রতি অনুরাগ জন্মায় এবং তারা ইসলাম গ্রহণ করে।
বিদায় হজ্ব
কালের পরিক্রমায় সমগ্র আরব উপদ্বীপ ইসলামের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তখন নবী মুহাম্মদ (সা.) হজ্ব পালনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি মদীনায় ও তার আশপাশের এলাকায় বসবাসরত মুসলমানদের জানিয়ে দেন এবং সবাইকে তাঁর সঙ্গে হজ্বে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান।
এটাই ছিল নবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় একমাত্র হজ্ব। এই উপলক্ষে তিনি হজ্বের সকল বিধান শিক্ষা দেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য যে বার্তা তাঁকে অর্পণ করা হয়েছিল, তা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন।
এই হজ্বের সময়, যা পরবর্তীতে বিদায় হজ্ব নামে পরিচিত হয়, তিনি আরাফাতের ময়দানে একটি ঐতিহাসিক খুতবা প্রদান করেন। এটি ছিল তাঁর মৃত্যুর প্রায় ৮১ বা ৮২ দিন পূর্বে। এই খুতবায় ইসলামের মৌলিক মূলনীতি ও নীতিবিধান অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি একটি উটে চড়ে অবস্থান করছিলেন এবং স্পষ্টভাবে ভাষণ প্রদান করেন। তিনি উপস্থিত সবাইকে অনুরোধ করেন যাতে তাঁরা এই বার্তা অনুপস্থিতদের কাছে পৌঁছে দেন।
তিনি বলেছিলেন:
“হে মানুষ, আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো, কারণ আমি জানি না—এই বছরের পর আমি আর তোমাদের মাঝে থাকব কিনা। তাই আমার কথা ভালোভাবে শোনো এবং যারা উপস্থিত নেই, তাদের কাছে পৌঁছে দাও।”
“হে মানুষ, যেমনিভাবে তোমরা এই মাস, এই দিন, এবং এই শহরকে পবিত্র মনে করো, তেমনি প্রতিটি মুসলমানের জীবন ও সম্পদকেও পবিত্র ও অগ্রাহ্যযোগ্য মনে করো। কারো আমানত ফেরত দাও তার ন্যায্য মালিককে। কাউকে কষ্ট দিও না, যাতে তোমাকেও কেউ কষ্ট না দেয়। জেনে রাখো, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের সামনে উপস্থিত হবে এবং তোমাদের আমলসমূহের হিসাব দিতে হবে।”
“আল্লাহ তোমাদের জন্য সুদ গ্রহণ নিষিদ্ধ করেছেন। সুতরাং এখন থেকে সকল সুদের পাওনা মাফ করা হলো। তোমরা শয়তানের ফাঁদে পড়ো না। সে আর বড় বিষয়ে তোমাদের বিভ্রান্ত করতে পারবে না, তবে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে যেন তোমাদের বিপথে না নিতে পারে—সেদিকে সতর্ক থাকো।”
“হে মানুষ, নারীদের ওপর তোমাদের কিছু অধিকার আছে, ঠিক তেমনি তাদের ওপরও তোমাদের অধিকার আছে। যদি তারা তোমাদের অধিকার পালনে সচেষ্ট থাকে, তবে তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে—তাদের খাদ্য ও পোশাক দয়া ও সম্মানের সঙ্গে দেবে। তাদের ভালোভাবে দেখাশোনা করো, কারণ তারা তোমাদের সহযোগী ও বিশ্বস্ত সাথী। এবং এটা তোমাদের অধিকার যে, তারা এমন কারো সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করবে না, যাকে তোমরা পছন্দ করো না এবং তারা কখনো ব্যভিচারে লিপ্ত হবে না।”
“হে মানুষ, আল্লাহর এবাদত করো, সালাত কায়েম করো, রমজানে রোযা রাখো, যাকাত প্রদান করো, এবং যারা সামর্থ্য রাখো, তারা হজ্ব আদায় করো। মনে রেখো, প্রত্যেক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। কেউ কারো ওপরে শ্রেষ্ঠ নয়, শুধুমাত্র তাকওয়া ও সৎকর্মই শ্রেষ্ঠতার মাপকাঠি।”
“একদিন তোমাদের আল্লাহর সামনে হাজির হতে হবে এবং তোমাদের কাজের জবাবদিহি করতে হবে। তাই আমার মৃত্যুর পর গোমরাহ হয়ে যেও না।”
“হে মানুষ, আমার পরে আর কোনো নবী বা রাসূল আসবে না এবং কোনো নতুন দ্বীনও আসবে না।”
“আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি—আল-কুরআন এবং আমার সুন্নাহ (চরিত্র ও শিক্ষাগুলো)। যদি তোমরা এগুলো ধারণ করো, তবে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না।”
“যারা আমার কথা শুনেছো, তারা যেন অন্যদের কাছে তা পৌঁছে দেয় এবং তাদের পরে অন্যরা যেন আরো ভালোভাবে তা বোঝে। হে আল্লাহ, সাক্ষী থাকো, আমি তোমার বার্তা পৌঁছে দিয়েছি।”
এই খুতবার গুরুত্ব বোঝা যায় নবী (সা.)-এর উপলব্ধি থেকে—এটাই হয়তো ছিল তাঁর জীবনের শেষ হজ্ব ও সর্বসাধারণের সঙ্গে শেষ একত্র হওয়া। তাই তিনি এই উপলক্ষে ইসলামের সার্বিক দিক ও মূলনীতিগুলো সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেন।
ইসলামের পূর্ণরূপ সকল মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার পর, মানবজাতির—বিশেষ করে মুসলমানদের—কোনো বিকল্প জীবনব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল না। যে কেউ কুরআন ও সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবে, সে কখনো বিপথে যাবে না।
প্রিয় নবী (সা.)-এর ওফাত
[দ্রষ্টব্য: আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওফাতের বিষয়টি কোনো মুসলমানের জন্যই সহজ নয়। এটি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ও সংবেদনশীল একটি ঘটনা। আজও সমস্ত মুসলমান তাঁর অনুপস্থিতি গভীরভাবে অনুভব করে থাকেন।]
হজ থেকে ফিরে আসার প্রায় দুই মাস পর নবীজি (সা.) গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থতার মাঝেও তিনি মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করতেন এবং সাহাবীদের দিকনির্দেশনা দিতেন। তবে দিন দিন তাঁর শারীরিক অবস্থা অবনতি হতে থাকে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি আবু বকর (রা.)-কে জামাতে নামাজ পড়ানোর নির্দেশ দেন।
নবীজির পরিবার এবং সাহাবারা সবাই তাঁর অসুস্থতা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। হিজরতের ১১তম বছরে, এক সোমবার তিনি ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
নবীজির ওফাত অনেক সাহাবা মেনে নিতে পারেননি। যেন মনে হচ্ছিল, আল্লাহর প্রেরিত রাসূল চিরকাল জীবিত থাকবেন। তবে আবু বকর (রা.) এই বাস্তবতাকে সবাইকে বুঝিয়ে দেন। তিনি বলেন:
“তোমরা যদি মুহাম্মদকে (সা.) উপাসনা করে থাকো, তবে জেনে রাখো তিনি মারা গেছেন। কিন্তু যদি আল্লাহকে উপাসনা করে থাকো, তবে জেনে রাখো, আল্লাহ চিরঞ্জীব।”
এরপর তিনি কুরআনের একটি আয়াত তিলাওয়াত করেন:
“মুহাম্মদ তো একজন রাসূল, তাঁর আগেও বহু রাসূল পার হয়ে গেছেন। তাহলে কি তিনি মারা গেলে বা শহীদ হলে, তোমরা পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে?”
— [সূরা আলে ইমরান ৩:১৪৪]
অনুসরণের নির্দেশনা
মুহাম্মদ (সা.) — মানুষ হিসেবে — ইন্তেকাল করেছেন। কিন্তু তাঁর বার্তা, নবুয়ত ও উত্তরাধিকার আজও টিকে আছে কুরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে। বিদায় হজের ভাষণে আরাফার ময়দানে তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন —
“আমি তোমাদের কাছে এমন দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যদি তোমরা তা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো, তবে কখনও পথভ্রষ্ট হবে না: তা হলো আল্লাহর কিতাব (কুরআন) ও আমার সুন্নাহ।”
তিনি যে শিক্ষা আমাদের রেখে গেছেন, তা যদি সঠিকভাবে, আন্তরিকতা ও যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়, তাহলে এই দুনিয়ার জীবন যেমন সুখময় হবে, তেমনি পরকালেও মুক্তি লাভ করা যাবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা — যা মানুষের পার্থিব জীবনকে গুরুত্ব দেয় এবং আখিরাতকে দুনিয়ার ধারাবাহিক রূপ হিসেবে বিবেচনা করে।
এমন ভাবা কঠিন যে, মানুষ দুনিয়ায় দিকভ্রষ্ট হয়ে থাকবে কিন্তু পরকালে মুক্তি পাবে। বরং প্রকৃত মুক্তির পথ হলো — দুনিয়ায় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দেখানো পথে চলা।
এক সাহাবি হযরত আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, নবীজির দৈনন্দিন জীবনযাপন কেমন ছিল? তিনি উত্তরে বলেছিলেন:
“তাঁর চরিত্র ছিল কুরআন।”
অর্থাৎ, রাসূল (সা.)-এর জীবনের প্রতিটি কাজই ছিল আল্লাহর কুরআনের বাস্তব প্রতিফলন। আল্লাহ তাঁকে কুরআনের ব্যাখ্যার অধিকার দিয়েছিলেন। তাই তাঁর জীবনাচার ছিল মানব জীবনের সর্বোত্তম আদর্শ।
উৎস:
কুরআনের আয়াত: সূরা আন্-নাসর, আলে ইমরান
The Quran Translated: Message for Humanity (অনুবাদ: এম. পিকথল), সংশোধন: International Committee for the Support of the Final Prophet
মূল ইংরেজি: Islam Newsroom
বিস্তারি আরও জানতে নিচের বই গুলো দেখতে পারেন ….
সীরাতে ইবনে হিশাম

বইটির প্রকাশনার তথ্য
বইঃ সীরাতে ইবনে হিশাম
মূলঃ ইবনে হিশাম
অনুবাদঃ আকরাম ফারুক
প্রকাশকঃ বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার ঢাকা
ISBN-984-31-0614-8
আর্-রাহীকুল মাখতূম

বইটির প্রকাশনার তথ্য
বইঃ আর-রাহীকুল মাখতূম
মূলঃ শাইখুল হাদীস আল্লামা সফিউর রহমান মুবারকপুরী (রহ.)
অনুবাদঃ আব্দুল খালেক রহমানী, মুয়ীনুদ্দীন আহমাদ
প্রকাশকঃ তাওহীদ পাবলিকেশন্স
ISBN-978-984-8766-06-4