ইসলামের প্রথম প্রজন্মের আলোকবর্তিকা
ইসলামের ইতিহাসে এমন একদল মহান ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, যাঁদের জীবন প্রতিটি মুসলমানের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁরা হলেন সাহাবী – রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সেইসব মহান সঙ্গী-সাথী, যাঁরা নিজেদের জীবনকে ইসলামের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁদের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি সিদ্ধান্ত ছিল রাসূল (সা.)-এর আদর্শের প্রতিচ্ছবি। তাঁদের জীবনই ছিল সেই ভিত্তি, যার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এক আদর্শ মানব সমাজ।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান বাংলাভাষী মুসলিম সমাজে এই মহান সাহাবীদের জীবনী চর্চা তুলনামূলকভাবে কম। অথচ তাঁদের জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এই নিবন্ধে আমরা সাহাবীদের পরিচয়, তাঁদের মর্যাদা এবং তাঁদের জীবনের সেইসব অনন্য গুণাবলী নিয়ে আলোচনা করব, যা তাঁদেরকে মানবজাতির জন্য এক অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত করেছে।
সাহাবী কারা? একটি বিস্তারিত পরিচিতি
‘সাহাবী’ শব্দটি আরবী ভাষার ‘সুহবত’ শব্দ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ সঙ্গ, সাথী বা সহচর। একবচনে ‘সাহেব’ ও ‘সাহবী’ এবং বহুবচনে ‘সাহাবা’, ‘আসহাব’ ও ‘সাহব’ ব্যবহৃত হয়। ইসলামী পরিভাষায়, ‘সাহাবা’ শব্দটি দ্বারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সেইসব মহান সঙ্গী-সাথীদের বোঝানো হয়, যাঁরা তাঁর প্রতি ঈমান সহকারে তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করেছেন এবং ইসলামের উপরই মৃত্যুবরণ করেছেন।
আল্লামা ইবন হাজার (রাহ.) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল-ইসাবা ফী তাময়ীযিস সাহাবা’-তে সাহাবীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তিনটি মূল শর্ত আরোপ করেছেন:
- রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ঈমান: সাহাবী হওয়ার জন্য রাসূল (সা.)-এর নবুওয়াতের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা অপরিহার্য।
- ঈমানের অবস্থায় তাঁর সাথে সাক্ষাৎ (আল-লিকা): এই সাক্ষাৎ শারীরিক উপস্থিতি বোঝায়, চোখে দেখা জরুরি নয়। যেমন, অন্ধ সাহাবী আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম (রা.) যিনি রাসূল (সা.)-কে চোখে দেখতে না পেলেও তাঁর সাথে সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন এবং তিনি একজন মর্যাদাবান সাহাবী ছিলেন। তাই, যারা রাসূল (সা.)-এর সাক্ষাৎ লাভ করেছেন কিন্তু ঈমান আনেননি (যেমন: আবু জাহল, আবু লাহাব), তারা সাহাবী নন।
- ইসলামের ওপর মৃত্যুবরণ (মাউত ‘আলাল ইসলাম): যিনি রাসূল (সা.)-এর সাথে ঈমান অবস্থায় সাক্ষাৎ করেছেন, পরবর্তীতে মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) হয়ে আবার ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন, তিনিও সাহাবী বলে গণ্য হবেন, যদি তিনি পুনরায় রাসূল (সা.)-এর সাক্ষাৎ লাভ নাও করেন। তবে, যে ব্যক্তি ইসলামের অবস্থায় রাসূল (সা.)-এর সাক্ষাৎ লাভ করেছে, কিন্তু পরে মুরতাদ অবস্থায় মারা গেছে (যেমন: আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ আল-আসাদী, যিনি হাবশায় হিজরত করার পর খ্রিস্টান হয়ে সেখানেই মারা যান), তিনি সাহাবী বলে গণ্য হবেন না।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:
- ঈমান সহকারে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে সাক্ষাতের পর তাঁর সাহচর্য কত দিনের জন্য ছিল (বেশি বা অল্প), তা সাহাবী হওয়ার শর্ত নয়।
- রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে কোনো হাদীস বর্ণনা করুক বা না করুক, তাতে সাহাবী হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব পড়ে না।
- রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে কোনো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করুক বা না করুক, তাতেও সাহাবী হওয়ার শর্ত পূরণ হয়।
- এমনকি, যে ব্যক্তির জীবনে মুহূর্তের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাক্ষাৎ ঘটেছে এবং ঈমানের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে, এমন সকলেই সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত।
- যারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ঈমান আনেননি, কিন্তু পূর্ববর্তী অন্য কোনো নবীর প্রতি ঈমান সহকারে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাক্ষাৎ লাভ করেছেন, তারা সাহাবী নন।
- ‘বুহাইরা’ রাহিবের মতো যাঁরা পূর্ববর্তী কোনো নবীর প্রতি ঈমান সহকারে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নবুওয়াত লাভের পূর্বে তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করেছেন এবং বিশ্বাস করেছেন যে, তিনি ভবিষ্যতে নবী হবেন – এমন ব্যক্তিদের সাহাবা হওয়া সম্পর্কে মুসলিম মনীষীরা কোনো সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করতে পারেননি।
সাহাবীর উল্লেখিত সংজ্ঞাটি ইমাম বুখারী, ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বলসহ অধিকাংশ পণ্ডিতের নিকট সর্বাধিক সঠিক বলে বিবেচিত।
সাহাবীদের আদর্শ সমাজ ও তাঁদের অনন্য গুণাবলী
সাহাবীদের সমাজ ছিল একটি আদর্শ মানব সমাজ। তাঁদের প্রতিটি কাজ মানবজাতির জন্য এক উৎকৃষ্টতম নমুনা স্বরূপ। তাঁদের জীবন ছিল সততা, বিশ্বস্ততা, ভদ্রতা, আত্মত্যাগ ও সদাচরণের এক তুলনাহীন দৃষ্টান্ত। তাঁরা ছিলেন একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহানুভূতিশীল। গরীব ও অভাবী মানুষের প্রয়োজন ও চাহিদাকে তাঁরা সবসময় অগ্রাধিকার দিতেন। বীরত্ব ও সাহসিকতায় তাঁরা ছিলেন নজীরবিহীন।
হযরত রাসূলে করীম (সা.) যে সর্বোত্তম সমাজের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, সাহাবায়ে কিরাম ছিলেন সেই সমাজের প্রথম ও বাস্তব নমুনা। রাসূলে পাকের (সা.) সুহবতের বরকতে তাঁরা মহান মানবতার বাস্তব রূপ ধারণ করেছিলেন। ‘আদল (ন্যায়বিচার), তাকওয়া (আল্লাহভীতি), দিয়ানাত (বিশ্বস্ততা), ইহসান (সুকর্ম) এবং খাওফে খোদা (আল্লাহর ভয়)-এর তাঁরা ছিলেন সমুজ্জ্বল প্রতীক। তাঁদের মধ্যে এই অনুভূতি সদা জাগ্রত ছিল যে, এই পৃথিবীতে তাঁদের আগমন ইসলামের ঝাণ্ডা সমুন্নত করা এবং মানবজাতির মধ্যে সমতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য। তাঁরা নিজেদেরকে ‘খিলাফতে ইলাহিয়া’র আমীন বা বিশ্বাসী রূপে আল্লাহর উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য নিবেদিত করেছিলেন।
পবিত্রতা ও নিষ্কলুষতা তাঁদের মধ্যে এমন পরিচ্ছন্ন হৃদয় ও ন্যায়ের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছিল যে, হক ও ইনসাফের ব্যাপারে তাঁরা যেমন নিজেদেরকে দায়িত্বশীল মনে করতেন, তেমন মনে করতেন অন্যদেরকেও। তাঁরা উচ্চপদে অধিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও নিজেদের সন্তান ও আত্মীয়-বন্ধুদের শরয়ী বিধানের শাস্তি থেকে বাঁচাতে পারেননি, বাঁচাতে চেষ্টাও করেননি।
মোটকথা, ঈমান ও বিশ্বাস তাঁদের সামগ্রিক যোগ্যতাকে আলোকিত করে দিয়েছিল। তাঁরা খুব অল্প সময়ে বিশ্বের সর্বাধিক অংশকে প্রভাবিত করেছিলেন। তাঁদের সামরিক ও সাংগঠনিক যোগ্যতার অসংখ্য নজীর ইতিহাসের পাতায় বিদ্যমান।
কেন সাহাবীদের জীবনী চর্চা প্রয়োজন?
সাহাবায়ে কিরামের আদর্শ সমাজের অনুরূপ সমাজ যদি আজ আমরা গড়তে চাই, তবে আমাদের অবশ্যই তাঁদের সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে হবে। তাঁদের মতো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। আর তার জন্য প্রয়োজন সাহাবীদের জীবনীর ব্যাপক চর্চা হওয়া এবং তাঁদের জীবন থেকে দিকনির্দেশনা গ্রহণ করা।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাভাষী মুসলিম সমাজে সাহাবীদের জীবনের চর্চা খুব কম। এখানে পীর-আওলিয়ার জীবনের কাল্পনিক কিস্সা-কাহিনী যে পরিমাণে আলোচিত হয়, তার কিয়দংশও সাহাবীদের জীবনীর আলোচনা হয় না। অথচ সাহাবীদের জীবনই হলো রাসূল (সা.)-এর আদর্শের বাস্তব প্রতিফলন।
পৃথিবীর অন্যান্য ভাষায় সাহাবীদের জীবনী ওপর বহু বড় বড় গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় সাহাবীদের জীবনীর উপর লেখা উল্লেখযোগ্য তেমন বইয়ের অভাব রয়েছে। এই অভাব পূরণের লক্ষ্যে ‘আসহাবে রাসূলের জীবনকথা’ শীর্ষক একটি সংক্ষেপিত গ্রন্থ রচিত হয়েছে, যা মোট ৬টি খন্ডে বিভক্ত। আশা করা যায়, এটি পাঠকদের চাহিদা কিছুটা হলেও মেটাবে:
- প্রথম খন্ডে: ৩০ জন সাহাবীর জীবনী।
- দ্বিতীয় খন্ডে: ৬২ জন সাহাবীর জীবনী।
- তৃতীয় খন্ডে: ২০ জন সাহাবীর জীবনী।
- চতুর্থ খন্ডে: ৩৯ জন সাহাবীর জীবনী।
- পঞ্চম খন্ডে: ১১ জন (রাসূলের স্ত্রীগণ) সাহাবীর জীবনী।
- ষষ্ঠ খন্ডে: ৩৬ জন (নারী সাহাবীদের জীবনী) সাহাবীর জীবনী।
উপসংহার: আদর্শ অনুসরণের আহ্বান
সাহাবীদের জীবন ছিল ত্যাগ, নিষ্ঠা, বীরত্ব, জ্ঞান এবং আল্লাহর প্রতি অবিচল ভালোবাসার এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। তাঁদের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল রাসূল (সা.)-এর শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগ। তাঁদের জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আমরা যেমন নিজেদের চারিত্রিক গুণাবলী উন্নত করতে পারি, তেমনি আমাদের সমাজকেও একটি ন্যায় ও তাকওয়াপূর্ণ সমাজে রূপান্তরিত করতে পারি। আসুন, আমরা সাহাবীদের জীবনী অধ্যয়ন করি এবং তাঁদের আদর্শকে আমাদের জীবনের পাথেয় করি।
বইটির প্রকাশনার তথ্য
বইঃ আসহাবে রাসূলের জীবনকথা
লেখক: মুহাম্মদ আবদুল মা’বুদ
প্রকাশকঃ বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার
ISBN-984-31-0707-1 set
nobi- e-pak jiboni jana sobar dorkar .asun amar chesta kori