ইসলামে, বনি ইসরাইল বা ‘ইসরাইলের সন্তানগণ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতি যাদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের ইতিহাস, নবী-রাসূলদের প্রতি তাদের আচরণ, আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত এবং তাদের কৃতকর্মের পরিণতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে । তাদের ইতিহাস থেকে মুসলিম উম্মাহর জন্য রয়েছে অনেক শিক্ষা । এই ব্লগে, আমরা ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে বনি ইসরাইলের পরিচয়, তাদের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং তাদের সম্পর্কে কুরআনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বার্তা তুলে ধরব।

বনি ইসরাইলের ইতিহাস বোঝা মানে কুরআনের বিশাল একটি অংশ সহজে অনুধাবন করা। কুরআনের বহু সূরা ও আয়াত সরাসরি তাদের ঘটনাবলির সাথে সম্পর্কিত, তাই এই জাতির অতীত জানলে কুরআন-তাফসীর বোঝা অনেক সহজ হয়ে যায়।

কুরআনে বনি ইসরাইল

কুরআনে “বনি ইসরাইল” শব্দটি ৪০ বারেরও বেশি এসেছে। আল্লাহ তাআলা তাঁদের সাথে করা অঙ্গীকার, প্রদত্ত নিয়ামত এবং অবাধ্যতার কারণে যে শাস্তি দিয়েছেন, তা বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন।

“হে বনি ইসরাইল! আমি তোমাদের প্রতি যে নিয়ামত করেছি, তা স্মরণ করো এবং আমার অঙ্গীকার পূর্ণ করো, আমি তোমাদের অঙ্গীকার পূর্ণ করব, আর শুধু আমারই ভয় করো।”
— (সূরা আল-বাকারা: ৪০)


বনি ইসরাইল কারা?

‘ইসরাইল’ নামটি হলো হযরত ইয়াকুব (আঃ)-এর উপাধি । ‘বনি ইসরাইল’ বলতে মূলত হযরত ইয়াকুব (আঃ)-এর বংশধরদের বোঝানো হয় । হযরত ইবরাহীম (আঃ)-কে ‘Father of faith’ বা বিশ্বাসের পিতা বলা হয়, এবং তিনি একেশ্বরবাদী তিনটি প্রধান ধর্ম—ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলাম—সবগুলোতেই স্বীকৃত ও সম্মানিত । হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর দুজন স্ত্রীর মাধ্যমে দুটি বংশধারার সৃষ্টি হয়: বিবি হাজেরার গর্ভ থেকে হযরত ইসমাইল (আঃ)-এর বংশধারা এবং বিবি সারাহর গর্ভ থেকে হযরত ইসহাক (আঃ)-এর বংশধারা । হযরত ইসহাক (আঃ)-এর পুত্র ছিলেন হযরত ইয়াকুব (আঃ) । এই বংশধারায় হযরত মূসা (আঃ), হযরত দাউদ (আঃ), হযরত সুলাইমান (আঃ) এবং হযরত ঈসা (আঃ) সহ বহু বিখ্যাত নবী-রাসূলের আগমন ঘটে । এই জাতিই বনি ইসরাইল নামে পরিচিতি লাভ করে।


ইহুদি ও বনি ইসরাইলের পার্থক্য

পবিত্র কুরআনে “ইহুদি” ও “বনি ইসরাইল” — এই দুই শব্দের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। “ইহুদি” মূলত একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীকে বোঝায়, যারা ইবরাহিমী ধর্মগুলির একটি শাখা অনুসরণ করে এবং হযরত মূসা (আঃ)-কে নবী হিসেবে মানে, আর তাদের পবিত্র গ্রন্থ হলো তাওরাত। অন্যদিকে “বনি ইসরাইল” বলতে বোঝানো হয় একটি জাতিগোষ্ঠীকে, যারা হযরত ইয়াকুব (আঃ)-এর বংশধর। ইতিহাসে বনি ইসরাইলের উত্থান-পতনের দীর্ঘ কাহিনি রয়েছে, যা কুরআনে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ আছে। কুরআনে ইহুদিদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায়শই নেতিবাচকভাবে এসেছে—কারণ তারা বহুবার আল্লাহর অবাধ্যতা করেছে, কিন্তু বনি ইসরাইলের ক্ষেত্রে কুরআন একটি জাতি হিসেবে তাদের ইতিহাস, নিয়ামত ও শাস্তির বিবরণ তুলে ধরেছে।

বনি ইসরাইলের ইতিহাস ও কুরআনের প্রাসঙ্গিকতা

বনি ইসরাইলের ইতিহাস ও তাদের সম্পর্কিত ঘটনাবলি পবিত্র কুরআনের একটি বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে । কুরআনে তাদের বিষয়ে আলোচনার মূল বিষয়গুলো হলো:

  • শাম থেকে মিশর: বংশানুক্রমে হযরত ইয়াকুব (আঃ)-এর বসবাস ছিল শাম দেশে, যা বর্তমানে সিরিয়া ও জেরুজালেমসহ একটি বিশাল এলাকা জুড়ে ছিল । কিন্তু হযরত ইয়াকুব (আঃ)-এর পুত্র হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর কাহিনির মাধ্যমে এই দুই অঞ্চলের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপিত হয় । ভাইয়েরা হিংসার বশবর্তী হয়ে হযরত ইউসুফ (আঃ)-কে একটি কূপে ফেলে দিলে তিনি ক্রীতদাস হিসেবে মিশরে চলে যান । আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি একসময় মিশরের মন্ত্রী হন এবং তার পুরো পরিবারকে মিশরে নিয়ে আসেন । এভাবেই বনি ইসরাইল মিশরে বসবাস শুরু করে ।
  • ‘মালিক’ ও ‘ফিরাউন’ উপাধি: হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর সময়ে মিশরের শাসককে কুরআন ‘মালিক’ (বাদশাহ) হিসেবে সম্বোধন করেছে, ‘ফিরাউন’ হিসেবে নয় । অথচ হযরত মূসা (আঃ)-এর সময়ে মিশরের প্রধানকে ‘ফিরাউন’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে । ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৫৬০ খ্রিষ্টপূর্বের পর থেকে মিশরের রাজারা ‘ফিরাউন’ উপাধি গ্রহণ করে, তার আগে নয় । বাইবেলে এই দুই সময়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই । কুরআনের এই সূক্ষ্ম পার্থক্য প্রমাণ করে এর ঐশ্বরিক উৎস ।
  • অসংখ্য নেয়ামত ও অবাধ্যতা: আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলকে অসংখ্য নেয়ামত দান করেছিলেন । কিন্তু তারা যুগে যুগে আল্লাহর অবাধ্যতা, নবীদের হত্যা এবং ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করেছে। এই সীমালঙ্ঘনের কারণে আল্লাহ তাদের উপর অভিশাপ দিয়েছেন।
  • দাসত্ব থেকে মুক্তি: হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর সময় হিক্সস জাতি মিশরের ক্ষমতায় থাকায় বনি ইসরাইল সম্মানের সাথে সেখানে বসবাস করত । কিন্তু পরে মিশরীয়রা ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করলে তারা বনি ইসরাইলের প্রতি প্রচণ্ড বিদ্বেষী হয়ে ওঠে এবং তাদের সাথে দাস-দাসীর মতো আচরণ শুরু করে । এই পটভূমিতে আল্লাহ হযরত মূসা (আঃ)-কে প্রেরণ করেছিলেন । কিন্তু বনি ইসরাইল তাদের দাসত্বের জীবনে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল যে, তারা এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি ছিল না ।

সংক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক বিবরণ ও মূল ঘটনাগুলো

  • ইবরাহিম (আঃ)-এর বংশধারা: বনি ইসরাইল আসলে ইসহাক (আঃ)-এর বংশধর, আরবদের পূর্বপুরুষ ইসমাইল (আঃ)-এর ভাইয়ের বংশ।
  • মিসরে দাসত্ব: ইউসুফ (আঃ)-এর মাধ্যমে তারা মিসরে প্রবেশ করে, কিন্তু পরবর্তীতে ফেরাউনের অধীনে দাসত্বে পতিত হয়।
  • মূসা (আঃ)-এর নেতৃত্বে মুক্তি: আল্লাহর নির্দেশে মূসা (আঃ) ফেরাউনের কাছ থেকে বনি ইসরাইলকে মুক্ত করেন, সমুদ্র দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়, এবং তারা নিরাপদে পার হয়।
  • তাওরাত প্রাপ্তি: সিনাই পর্বতে মূসা (আঃ)-এর হাতে আল্লাহ তাওরাত প্রদান করেন।
  • ৪০ বছরের বনবাস: অবাধ্যতার কারণে তারা মরুভূমিতে ৪০ বছর ঘুরে বেড়ায়।
  • দাউদ (আঃ) ও সুলাইমান (আঃ)-এর রাজত্ব: ঐক্যবদ্ধ রাজত্ব ও জেরুজালেমে মসজিদে আকসা নির্মাণ।

বনি ইসরাইলের ইতিহাস থেকে শিক্ষা

বনি ইসরাইলের ইতিহাস মুসলিম উম্মাহর জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা বহন করে । এই ইতিহাস থেকে আমরা যা শিখতে পারি:

  • আল্লাহর সাহায্যের শর্ত: আল্লাহর সাহায্য কোনো জাতির কেনা স্থায়ী সম্পত্তি নয় যে, তা চাইলেই আকাশ থেকে নেমে আসবে । বরং এটি শর্তসাপেক্ষ, যা অর্জন করে নিতে হয় । সিরিয়া বা ফিলিস্তিনে নিরীহ শিশুদের ওপর নির্যাতন দেখে আল্লাহর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করা অমূলক, কারণ এগুলো আমাদেরই কর্মফল ।
  • অবাধ্যতা ও পরিণতি: চরম সম্মানজনক অবস্থা থেকে লাঞ্ছনার চূড়ান্ত পর্যায়ে নেমে আসার ঘটনা বনি ইসরাইল ও মুসলিম উভয়ের সাথেই ঘটেছে । বিস্ময়করভাবে, এই দুটি জাতির উত্থান ও পতনের ঘটনাপ্রবাহ এতই সাদৃশ্যপূর্ণ যে, গ্রাফে উপস্থাপন করলে তাদের আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়বে । এর কারণ হলো, আমরা তাদের একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করেছি । তাই তাদের পরিণতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা আমাদের জন্য অপরিহার্য ।
  • ত্যাগ ও পরিবর্তন: বনি ইসরাইল তাদের দাসত্বের জীবন থেকে মুক্তি পেতে কোনো ত্যাগ স্বীকারে রাজি ছিল না । একইভাবে, বর্তমান মুসলিম উম্মাহও অনেক সমস্যায় জর্জরিত। কিন্তু এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে যে সামান্য ত্যাগ দরকার, তা আমরা করতে প্রস্তুত নই ।

রাসূলুল্লাহ ﷺ সতর্ক করেছেন:

“তোমরা বনি ইসরাইলের মতো হবে না।” — সহীহ বুখারী

বনি ইসরাইলের ইতিহাস কেবল একটি জাতির গল্প নয়, বরং এটি মানবজাতির জন্য একটি সতর্কবার্তা । তাদের উত্থান ও পতন, আল্লাহর নেয়ামত ও শাস্তি, আনুগত্য ও অবাধ্যতার এই কাহিনি থেকে আমরা শিখতে পারি যে, আল্লাহর পথে চলা এবং তার আদেশ মেনে চলায়ই রয়েছে সফলতা ও মুক্তি । এই ইতিহাস আমাদেরকে নিজেদের ভুলগুলো চিহ্নিত করতে এবং সঠিক পথে ফিরে আসার প্রেরণা যোগায়

বিস্তারিত কাহিনি জানতে আগ্রহীদের জন্য

উপরের আলোচনা বনি ইসরাইলের ইতিহাসের একটি সংক্ষিপ্ত সারসংক্ষেপ মাত্র। যদি পাঠক আরও গভীরভাবে ঘটনাগুলোর ক্রমবিন্যাস, ঐতিহাসিক পটভূমি, কুরআনের আয়াতের সাথে মিলিয়ে বিশ্লেষণ, এবং বিভিন্ন নবীর জীবনীসহ পূর্ণ কাহিনি জানতে চান, তাহলে তারা আমাদের প্রস্তাবিত PDF বই “শিকড়ের সন্ধানে” পড়তে পারেন।
এই বইতে হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর মিশরে আগমন থেকে শুরু করে হযরত মূসা (আঃ)-এর মাধ্যমে মুক্তি, মরুভূমির ৪০ বছরের ঘটনাপ্রবাহ, হযরত দাউদ (আঃ) ও সুলাইমান (আঃ)-এর শাসনকাল, এবং হযরত ঈসা (আঃ)-এর সময় পর্যন্ত বনি ইসরাইলের দীর্ঘ ইতিহাস বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। পাঠক সেখানে প্রত্যেকটি ঘটনার সাথে কুরআনিক রেফারেন্স ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ একসাথে পাবেন।

PDF File

ফেসবুকে যারা মন্তব্য করেছেনঃ
(Visited 7 times, 1 visits today)