বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
সত্য-মিথ্যার চিরকালীন দ্বন্দ্বে মিথ্যাবাদীরা কৌশল খাটিয়ে কিছুদিনের জন্য টিকতে পারে – তা নিয়ে এক খুৎবাতে উস্তাদ নুমান আলী খান কুর’আন হাদীস থেকে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাদের ৫টি কৌশলের। লেখাটা একটু বড় হতে পারে, একটু ধৈর্য ধরে পড়ার অনুরোধ রইলো।
মিথ্যাবাদীদের কৌশলগুলো বলার আগে দেখি আল্লাহ সত্যকে কীভাবে চিত্রায়িত করেছেন কুর#আনে। সত্য সবসময় আগ্রাসী আর মিথ্যাকে সামনে পেলেই চুরমার করে ফেলে:
“আমরা সত্যের দ্বারা মিথ্যার উপর আঘাত হানি, ফলে তার মগজ চুরমার হয়ে যায়, তখন দেখো! তা অন্তর্হিত হয়। আর ধিক তোমাদের প্রতি! তোমরা যা আরোপ কর সেজন্য।“ [সূরা আম্বিয়া: ১৮]
সত্যের নিজের কোন অস্ত্র লাগেনা। মিথ্যাকে মারার জন্য সত্য নিজেই এক অস্ত্র। কোন বিষয়ের সত্য মিথ্যা একসাথে রাখলে সত্য একদম নিঃশেষ করে দেয় মিথ্যা কে। সত্য খুবই আগ্রাসী এ ব্যাপারে। সত্যের আগমনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত তারাই হয় যারা এতদিন মিথ্যা কিছু তথ্য আর বিশ্বাসের উপর ভর করে বিশাল বিশাল ইমারত তৈরি করে নিয়েছে আর প্রজন্মের পর প্রজন্ম অন্ধভাবে তা মেনে চলছে।
এইসব অহংকারী মিথ্যাবাদীরা কিভাবে সত্যকে নিশ্চিতভাবে জানার পরও প্রথম যে কৌশল এর আশ্রয় নেয় তা হল By Force বা পেশী শক্তি আর ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে। যেমন:
ছোট একটা ছেলে তার এক বড় ভাইকে বিরবির করে বলল: ২+২=৪
বড়ভাই বলে উঠল ভারী গলায় “না, ২+২ =৫”
“কিন্তু দেখুন ২ হচ্ছে ১ যোগ ১ আর…”
“থাম, আমি বলছি ৫ , তাই ৫ এখন অফ যাও”
ইব্রাহীম (আঃ) যখন তার গোত্রদের বললেন তোমরা ভুল ইলাহদের প্রার্থনা করছো আর জবাবে ওরা বলল: তাই না? ওকে জীবন্ত পুড়াও।
শুধু জোর খাটিয়ে পেশী শক্তি আর হুংকার দিয়ে সত্যকে দূরে ঠেলে দেয়।
দ্বিতীয় কৌশল হল চরিত্র হনন। আগের উদাহরণে আসি।
– “জান ভাইয়া ২+২=৪”
– “তাই না? তুমি তো বাইট্টা, ঠিকমত হাটতেও পারোনা আর আমারে আইসো শিখাইতে, না?”
মুসা (আঃ) যখন সত্যের দাওয়াত নিয়ে আসলেন তখন ফিরাউন বলত, ও আর কী দাওয়াত দিতে আসছে? ও নিজেও একজনকে খুন করে পালিয়ে গিয়েছিল আর এখন যাদু করে বেড়ায়। কী আশা কর আর ওর থেকে?
এইভাবে যখন কেউ সত্য কথা সম্মুখে বলে তখন যে লোকটি কথাটি বলল তাকে নিয়ে, তার চরিত্র নিয়ে এরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
তৃতীয় কৌশল হল বিশাল এক জনসমাগমের আয়োজন করা আবেগী মানুষদের নিয়ে।
এটি হল ফিরাউনের কৌশল। মুসা (আঃ) কে হেনেস্তা করার জন্য নিজের মানুষদের নিয়ে বিশাল এক জনসমাগম করেছিল। মুসা(আঃ) তার মোজেজা দেখাবেন আর ফিরাউনের যাদুকরেরা যাদু দেখাবে। মুসা (আঃ) যাই বলবেন আর যাই করবেন আর তখনই লোকেরা Boooooooooo করে উঠবে। সত্য কথা হলেও। মোটামুটি এই হল কৌশল।
পরে অবশ্য যাদুকরেরা ঐ জনসমাগমেই ঈমান আনলেন আর ফিরাউন যাদুকরদের বলল আমি জনতাম তোমরা এইখানে আসার আগে মুসার সাথে গোপন আলাপ করে এসেছিলে!
যখনই যুক্তিতে পেরে উঠেনা, তখনই এই সমমনা জনতার প্রয়োজন হয় আর এতেই প্রমাণিত হয় যে তাদের যুক্তির দৌড় কত দূর! এই জনতার কোন একজনের সাথে যদি ব্যক্তিগত কথা বলা যায় দেখা যাবে যুক্তিসহ কথা বার্তা হচ্ছে কিন্তু ঐ যখনই জনসমুদ্রে যায় তখন আর কিছুর ধার ধারে না, যা বলছি তাই, তুমি ভণ্ড!
চতুর্থ কৌশলটা একটু গভীর আর ভয়ংকরও বটে। তা হল সে দাওয়াত নিয়ে আসছে সত্যের উপর তার নিজের আনুগত্যের প্রশ্ন তুলবে তারা। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করা। যেমনঃ
একজন তার বাবাকে বলল, বাবা তোমার আয়ে তো সুদ জড়িত একটু …
এইতো শুরু হল বাবার,
“তোমাকে বড় করছে কে? এতদিন দিনের পর দিন কষ্ট করে খাইয়েছি, পড়িয়েছি, আর এইসব কথা শুনাও না এখন? কী পালছি আমি!!?? খুব ইসলাম পালন করছো তাই না? দেখছি তো কেমন ইসলাম। ইসলাম এই শিখায় না? বাবা-মার সাথে এই আচরণ শিখছো না?……”
যাই হোক ছেলে যে সুদের প্রসঙ্গ তুলে আনলে সেটি এই কৌশলে ঢাকা পড়ে গেল।
নবীজী (সাঃ) কে উদ্দেশ্য করে কাফেররাও বলত যে সে নাকি শান্তি আনতে চাচ্ছে অথচ আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ইসলামের দাওয়াত নিয়ে আসার পর অশান্তি আরও বেড়ে গেছ। ভাই-ভাই, স্বামী-স্ত্রী, বাবা-ছেলে বন্ধন ভেঙ্গে যাচ্ছে… ইত্যাদি ইত্যাদি।
আর সর্বশেষ আর সবচেয়ে জনপ্রিয় কৌশল হল ভুলভাবে উদ্ধত করা। সোজা বাংলায় “ত্যানা পেঁচানো”। ফেসবুকের জামানায় এটা তো আরও বেশি হয়।
যেমন কেউ একজন বলল তুমি যেটা করছ ঐটা তো হাদীসে নিষেধাজ্ঞা আছে।
অন্যজন বলল ঐ হাদীসটা কে বর্ণণা করেছে?
– জানি না।
– ও, জানও না? (দলবল নিয়ে হেসে উঠল) আর হাদীসের কথা বল না??
আর কেউ একজন কমেন্ট করল। আর অন্যজন এসে মূল কমেন্ট নিয়ে কিছু না বলে কমেন্টের বানানে কী ভুল হল আর অন্য প্রসঙ্গ টেনে এনে মূল কথা থেকে অনেক দূরে সরে এসে কথা বাড়িয়ে ছাড়ল।
এই হল মোটামুটি কৌশলগুলো। সত্য আসার পর মানুষ কেন তা অস্বীকার করে এই সব কৌশলের আশ্রয় নেয় তার কারণ বিশ্লেষণ করলে একটাই উপসংহার আসে। তা হল মানুষের “EGO বা অহংকার”।
[সূত্রঃ উস্তাদ নুমান আলী খানের “Quranic Imagery” লেকচার অবলম্বনে]