ইসলাম একটি নিখুঁত মতাদর্শ এবং পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। এ জীবন ব্যবস্থার অনুসারী হতে হলে এবং এর প্রতিটি নির্দেশনা সঠিকভাবে পালন করতে হলে জ্ঞানার্জন অপরিহার্য। সহজ কথায় বলতে গেলে, ইসলামকে ‘জানা’ এবং ‘মানা’ উভয়ই একজন মুসলিমের জন্য বাধ্যতামূলক। বস্তুত, না জেনে, না বুঝে কোনো কিছুই সঠিকভাবে মানা ও কার্যকর করা যায় না। ইসলাম যেহেতু মানুষের জীবনের সর্বস্তরে কার্যকর হওয়ার জন্য এসেছে, তাই ইসলামকে জানা, বোঝা এবং এর সঠিক ও যথার্থ জ্ঞান অর্জন করা অত্যন্ত জরুরি ও অপরিহার্য – ফরয

মহান আল্লাহ তায়ালা কেবল দীন ইসলামকে মানুষের জীবন যাপন পদ্ধতি হিসেবে প্রেরণ করেই ক্ষান্ত হননি, বরং ইসলামকে জানতে ও বুঝতে নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলামের জ্ঞানার্জনের জন্য তিনি উৎসাহিত করেছেন এবং এর বাস্তব শিক্ষা প্রদানের জন্য রাসূল (সা.)-কে শিক্ষক ও আদর্শ নেতা হিসেবে পাঠিয়েছেন। রসূল সা. শিক্ষক ও আদর্শ নেতা হিসেবে বাস্তবে শিক্ষা দানের মাধ্যমে তাঁর সে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে গেছেন।

কুরআনের আলোকে জ্ঞানার্জন

পবিত্র কুরআনুল কারীমে জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব সম্পর্কে অসংখ্য আয়াত রয়েছে। এখানে কিছু উল্লেখযোগ্য আয়াত উল্লেখ করা হলো:

১. “পড়ো, তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।”

  • সূরা আলাক: আয়াত ১ এই আয়াতটি ইসলামের প্রথম অহী, যা জ্ঞানার্জনের প্রাথমিক নির্দেশ হিসেবে এসেছে। এটি পাঠ এবং জ্ঞান অন্বেষণের ভিত্তি স্থাপন করে।

২. “বলো: হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন।”

  • সূরা ত্বহা: আয়াত ১১৪ এই আয়াতে আল্লাহ নিজেই রাসূল (সা.)-কে জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য দোয়া করতে বলেছেন, যা জ্ঞানের গুরুত্বকে আরও সুদৃঢ় করে।

৩. “যদি তোমরা না জানো, তবে জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করে জেনে নাও।”

  • সূরা আন-নাহল: আয়াত ৪৩ এটি জ্ঞানের উৎস হিসেবে বিশেষজ্ঞদের কাছে ফিরে যাওয়ার এবং জ্ঞানীদের পরামর্শ নেওয়ার নির্দেশ দেয়।

৪. “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের সুউচ্চ মর্যাদা দান করবেন।”

  • সূরা আল-মুজাদালা: আয়াত ১১ এই আয়াতে আল্লাহ স্পষ্টভাবে ঈমানদার ও জ্ঞানীদের মর্যাদার কথা উল্লেখ করেছেন, যা দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের উচ্চাসনের ইঙ্গিত দেয়।

৫. “যারা জানে আর যারা জানে না এই উভয় ধরনের লোক কি সমান হতে পারে?”

  • সূরা যুমার: আয়াত ৯ এই আয়াত জ্ঞানীদের উচ্চ মর্যাদা এবং জ্ঞান ও অজ্ঞতার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য তুলে ধরে।

৬. “এবং সুবিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানী লোকরাও এই সাক্ষ্যই দেয় যে মহাপরাক্রমশালী বিজ্ঞানময় আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই।”

  • সূরা আলে ইমরান: আয়াত ১৮ এটি জ্ঞানের মাধ্যমে আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষ্যদানের গুরুত্ব বোঝায়।

৭. “আল্লাহর বান্দাহদের মধ্যে কেবল জ্ঞানসম্পন্ন লোকেরাই তাঁকে ভয় করে।”

  • সূরা ফাতির: আয়াত ২৮ এই আয়াতটি জ্ঞান এবং আল্লাহভীতির মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করে। সত্যিকারের জ্ঞানীরাই আল্লাহর প্রকৃত পরিচয় লাভ করে এবং তাঁকে ভয় করে।

৮. “আল্লাহ অতি প্রশস্ত উদার মহাজ্ঞানী। তিনি যাকে চান জ্ঞান দান করেন। আর যাকে জ্ঞান দেয়া হয়, সে তো বিরাট কল্যাণের অধিকারী। শিক্ষা লাভ করে তো কেবল তারাই যারা বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী।”

  • সূরা বাকারা: আয়াত ২৬৮-২৬৯ এই আয়াত জ্ঞানকে মহাকল্যাণ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং জ্ঞানার্জনের জন্য বুদ্ধিমান হওয়ার ওপর জোর দেয়।

৯. “যেমন আমি তোমাদের থেকেই তোমাদের কাছে একজন রাসূল পাঠিয়েছি। সে তোমাদেরকে আমার আয়াত পড়ে শুনায়, তোমাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ ও বিকশিত করে তোলে, তোমাদের আল কিতাব ও হিকমাহ (কর্মকৌশল) শিক্ষা দেয়, তোমাদের আরো শিক্ষা দেয় তোমরা যা কিছু জানো না সেগুলো।”

  • সূরা বাকারা: আয়াত ১৫১ এই আয়াত রাসূল (সা.)-এর শিক্ষাদানের ভূমিকার উপর জোর দেয়, যেখানে তিনি জ্ঞান, পবিত্রতা এবং প্রজ্ঞা প্রদান করতেন।

হাদীসের আলোকে জ্ঞানার্জন

আল কুরআনের এ আয়াতগুলো থেকে মুসলিমদের জন্য জ্ঞানার্জনের অপরিহার্যতা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়। জ্ঞানার্জন সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.)ও বিশেষভাবে তাগিদ করেছেন। তাঁর কিছু মূল্যবান বাণী নিচে উল্লেখ করা হলো:

১. “আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে তিনি দীনের সঠিক বুঝ-জ্ঞান দান করেন।”

  • সহীহ বুখারী ও মুসলিম এই হাদীসটি ইঙ্গিত দেয় যে, দীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করা আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ অনুগ্রহ ও কল্যাণের নিদর্শন।

২. “সোনা-রূপার খনির মতো মানুষও (বিভিন্ন প্রকারের) খনি। তাদের মধ্যে যারা ইসলাম গ্রহণের পূর্বে উত্তম (গুণ বৈশিষ্ট্যধারী) হয়ে থাকে, দীনের সঠিক বুঝ-জ্ঞান লাভ করতে পারলে ইসলাম গ্রহণের পরও তারাই উত্তম মানুষ হয়ে থাকে।”

  • সহীহ মুসলিম: আবূ হুরাইরা (রা.) এই হাদীস মানুষের সহজাত গুণাবলীর সাথে জ্ঞানের সম্পর্ক স্থাপন করে এবং দেখায় যে, সঠিক জ্ঞান মানুষকে আরও উন্নত করে তোলে।

৩. “জ্ঞানান্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলিমের একটি অবশ্য কর্তব্য কাজ।”

  • ইবনে মাজাহ, বায়হাকী এটি জ্ঞানার্জনকে প্রতিটি মুসলিমের জন্য একটি ফরয (বাধ্যতামূলক) কাজ হিসেবে ঘোষণা করে, যা এর গুরুত্বকে চূড়ান্ত করে।

৪. “ইসলামের একজন সঠিক জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তি শয়তানের জন্যে হাজারো (অজ্ঞ) ইবাদতগুজারের চাইতে ভয়ংকর।”

  • তিরমিযী এই হাদীস জ্ঞানীর মর্যাদা অজ্ঞ ইবাদতকারীর চেয়ে অনেক বেশি বলে উল্লেখ করে, কারণ জ্ঞানী ব্যক্তি ইসলামের সঠিক পথে থেকে শয়তানের প্ররোচনা প্রতিরোধে অধিক সক্ষম।

৫. “জ্ঞান অন্বেষণকারী ব্যক্তি তা থেকে বিরত না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহর পথে জিহাদে লিপ্ত বলে গণ্য হয়।”

  • তিরমিযী, দারমী এটি জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়াকে আল্লাহর পথে জিহাদের (প্রচেষ্টা) সমতুল্য বলে ঘোষণা করে, যা এর আধ্যাত্মিক মূল্যকে তুলে ধরে।

৬. “যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের কোনো পথ অবলম্বন করে, তাতে আল্লাহ তার জন্যে জান্নাতের একটি পথ সহজ করে দেন। যখন কিছু লোক আল্লাহর কোনো ঘরে একত্রিত হয়ে আল্লাহর কিতাব (কুরআন) পড়ে এবং নিজেদের মাঝে তার মর্ম আলোচনা করে, তখন তাদের উপর নেমে আসে প্রশান্তি, ঢেকে নেয় তাদেরকে আল্লাহর রহমত, পরিবেষ্টিত করে তাদেরকে ফেরেশতাকুল। তাছাড়া আল্লাহ তাঁর কাছের ফেরেশতাদের নিকট তাদের কথা আলোচনা করেন। যার আমল (কর্ম) তাকে পিছিয়ে দেয়, তার বংশ তাকে এগিয়ে দিতে পারে না।”

  • সহীহ মুসলিম এই দীর্ঘ হাদীসটি জ্ঞানার্জনের বহুবিধ বরকত তুলে ধরে: জান্নাতের পথ সহজ হওয়া, আল্লাহর রহমত, ফিরিশতাদের বেষ্টন এবং আল্লাহর কাছে তাদের আলোচনা।

৭. “ফেরেশতারা জ্ঞানান্বেষণকারীদের জন্যে নিজেদের ডানা বিছিয়ে দেয় (অর্থাৎ তাদের সহযোগিতা করে ও উৎসাহিত করে)।”

  • মুসনাদে আহমাদ এটি জ্ঞান অন্বেষণকারীদের জন্য ফেরেশতাদের সম্মান ও সহযোগিতার ইঙ্গিত দেয়।

৮. “জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে আকাশ ও পৃথিবীর অধিবাসীরা, এমনকি পানির নিচের মাছ। অজ্ঞ ইবাদতগুজারের তুলনায় জ্ঞানী ব্যক্তি ঠিক সেরকম মর্যাদাবান, যেমন পূর্ণিমা রাতের চাঁদ পৃথিবীবাসীর কাছে তারকারাজির উপর দীপ্তিমান। আর জ্ঞানীরা নবীদের ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারী।”

  • আহমাদ, তিরমিযী, আবূ দাউদ এই হাদীস জ্ঞানীদের অসাধারণ মর্যাদা তুলে ধরে: সমগ্র সৃষ্টির দ্বারা তাদের জন্য দোয়া করা হয়, তারা নবীদের উত্তরাধিকারী এবং তাদের জ্ঞান পূর্ণিমার চাঁদের মতো আলোকিত।

কোন জ্ঞান অর্জন করা ফরয?

জ্ঞানের রয়েছে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা। একজন মুসলিমের জন্য কোন জ্ঞান এবং কতটুকু জ্ঞান অর্জন করা ফরয, এ বিষয়টি জানা জরুরি। ইসলামের আলোকে গুরুত্বের দিক থেকে জ্ঞানকে কয়েকভাগে ভাগ করা যায়:

১. দীন ও শরীয়া সংক্রান্ত জ্ঞান (ফরযে আইন):

  • এ জ্ঞান অর্জন করা ফরয (বাধ্যতামূলক)। অর্থাৎ একজন মুসলিমকে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ঈমান-আকিদা সংক্রান্ত সঠিক জ্ঞান লাভ করতে হবে। ইসলামের মৌলিক নীতিসমূহ তার জানা থাকতে হবে। শরীয়তের মৌলিক বিধি-বিধানসমূহ (যেমন: নামাজ, রোজা, যাকাত, হজ্ব) তার জানা থাকতে হবে। সর্বোপরি, শরীয়তের মৌলিক বিধি-বিধানসমূহ পালন করা, প্রয়োগ করা এবং বাস্তবায়ন করার শরীয়তসম্মত পদ্ধতি তার জানা থাকতে হবে। নিজের জীবিকা উপার্জনের হালাল ও বৈধ প্রক্রিয়া তার জানা থাকতে হবে। এসব জ্ঞান অর্জন করা তার জন্য ফরযে আইন (প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য স্বতন্ত্রভাবে ফরয)।

২. দীনের অনুসন্ধানী জ্ঞান (ফরযে কিফায়া):

  • মুসলিমদের মধ্যে সর্বকালেই এমন একদল লোক ছিলেন এবং থাকতে হবে, যারা ইসলামের অনুসন্ধানী জ্ঞান অর্জন করবেন এবং ইজতিহাদ করার যোগ্যতা অর্জন করবেন। কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে যুগ-সমস্যা ও নতুন নতুন বিষয়সমূহের সমাধান পেশ করা এ দলের দায়িত্ব। দীনের অনুসন্ধানী জ্ঞান অর্জন করা ফরযে কিফায়া। অর্থাৎ, মুসলিম সমাজের কিছু সংখ্যক ব্যক্তি যদি এই জ্ঞান অর্জন করে, তবে অন্যদের ওপর থেকে এর ফরযিয়াত উঠে যায়। তবে যদি কেউ এই দায়িত্ব পালন না করে, তাহলে সমগ্র মুসলিম সমাজ গুনাহগার হবে।

৩. মুস্তাহাব জ্ঞান:

  • উপরোক্ত দুই ধরনের জ্ঞান ছাড়া মানব সমাজের জন্য কল্যাণকর অন্যান্য জ্ঞানার্জন (যেমন: বিজ্ঞান, চিকিৎসা, প্রকৌশল, কৃষি ইত্যাদি) মুস্তাহাব বা পছন্দনীয়। এ ধরনের জ্ঞান সমাজের উন্নতির জন্য অপরিহার্য।

৪. ক্ষতিকর জ্ঞান:

  • যেসব বিষয়ের জ্ঞানে ব্যক্তি বা মানব সমাজের কোনো কল্যাণ নেই, বরং ক্ষতিকর ও সময় অপচয়কারী, কোনো মুসলিমের উচিত নয় সেসব জ্ঞান অর্জন করা। রাসূলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন: “হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে পানাহ চাই সেই জ্ঞান থেকে যাতে কোনো কল্যাণ নেই এবং সেই অন্তর থেকে যার মধ্যে তোমার ভয় নেই।” (সহীহ মুসলিম)

জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব মুসলিম জীবনে অনস্বীকার্য। এটি কেবল ব্যক্তিগত উন্নতির চাবিকাঠি নয়, বরং একটি সুস্থ ও সুশৃঙ্খল মুসলিম সমাজ গঠনেরও ভিত্তি। জ্ঞানই আমাদের সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে, তাঁর আদেশ-নিষেধ বুঝতে এবং দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনে সফল হতে সাহায্য করে।

ফেসবুকে যারা মন্তব্য করেছেনঃ

(Visited ১,২৪০ times, ১ visits today)