বর্তমান সময়ে নাস্তিক ও ইসলামবিদ্বেষীরা প্রায়ই একটি প্রশ্ন তোলে: যদি আল্লাহ থাকেন, তবে তিনি কেন মানুষকে এত দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-আপদে ফেলেন? কেন তিনি সাহায্য করেন না?

এই প্রশ্নটি নতুন নয়। এর উত্তর আল্লাহ নিজেই কুরআনে দিয়েছেন। আল্লাহ আমাদের এই দুনিয়ার জীবনে কেবলই উপভোগ করার জন্য পাঠাননি; বরং পরীক্ষা করার জন্য পাঠিয়েছেন।

দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবন

এই দুনিয়ার জীবন আল্লাহর কাছে একটি ক্ষণস্থায়ী সময় মাত্র। তিনি একে পরীক্ষা ও ইবাদতের জন্য নির্ধারণ করেছেন। কোরআনে এই জীবনের স্বরূপ বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন:

“জেনে রাখো, পার্থিব জীবন কেবলই খেল-তামাশা, সাজ-সজ্জা, পারস্পরিক অহংকার এবং ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা মাত্র। এর উপমা হলো বৃষ্টির মতো, যার উৎপাদিত ফসল কৃষকদের আনন্দ দেয়, তারপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি তা হলুদ দেখতে পাও, অবশেষে তা খড়-কুটোয় পরিণত হয়।” (সূরা আল-হাদীদ, ৫৭:২০)

কেয়ামতের দিন যখন মানুষকে পুনরুত্থিত করা হবে, তখন তারা দুনিয়ার জীবনের সময়কাল নিয়ে অনুতপ্ত হবে। আল্লাহ সেদিন তাদের জিজ্ঞেস করবেন:

“তোমরা পৃথিবীতে কত বছর ছিলে?” তারা বলবে: “আমরা ছিলাম একদিন বা তারও কম সময়।” তখন আল্লাহ বলবেন: “যদি তোমরা জানতে, তাহলে তোমরা তো সেখানে সামান্য সময়ই ছিলে।” (সূরা আল-মু’মিনুন, ২৩:১১২-১১৪)

এই আয়াতগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে, আখিরাতের অনন্ত জীবনের তুলনায় এই দুনিয়ার জীবন এতটাই সংক্ষিপ্ত যে তা এক মুহূর্তের চেয়েও কম বলে মনে হবে।

জীবন একটি পরীক্ষা

আল্লাহর কাছে আমাদের এই জীবনই হলো একটি পরীক্ষা। তিনি বলেন:

“যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন, তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য—কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম।” (সূরা আল-মুলক, ৬৭:২)

এই পরীক্ষার মাধ্যমেই প্রকাশ পায়, কারা সত্যিকার অর্থে ধৈর্যশীল, কারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে এবং কারা বিপদ-আপদে হতাশ হয়ে যায়।

বিপদ-আপদ আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা

আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করেন, যেমনটি তিনি কুরআনে বলেন:

“আর যদি আল্লাহ তোমাকে কোন কষ্ট দেন, তবে তিনি ছাড়া তা দূর করার কেউ নেই। আর যদি তিনি তোমার মঙ্গল চান, তবে তাঁর অনুগ্রহ রদ করারও কেউ নেই। তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে চান তাকে তা দেন। আর তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সূরা আল-আন’আম, ৬:১৭)

“আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো ভয়, ক্ষুধা, ধন-সম্পদ ও প্রাণহানি এবং ফল-ফসলের ক্ষতি দ্বারা। আর সুসংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের।” (সূরা আল-বাকারা, ২:১৫৫)

অন্য আয়াতে তিনি আরও বলেন:

“মানুষ কি মনে করে যে, তারা শুধু বললেই যে আমরা ঈমান এনেছি, তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না?” (সূরা আল-আনকাবুত, ২৯:২)

এই আয়াতগুলো থেকে পরিষ্কার যে, কষ্ট, রোগ, ক্ষুধা, মৃত্যু—সবকিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা। আমাদের ঈমানের দৃঢ়তা যাচাই করার জন্য এই পরীক্ষাগুলো অপরিহার্য।

পরীক্ষা সুনির্দিষ্ট এবং ন্যায়বিচার আখিরাতে সম্পূর্ণ

আল্লাহ কোনো প্রাণকে তার সাধ্যাতীত কোনো বোঝা চাপান না। প্রতিটি পরীক্ষা সুনির্দিষ্ট এবং আপনার ক্ষমতার ভেতরেই হয়।

আল্লাহ বলেন:

“আল্লাহ কোনো প্রাণকে তার সাধ্যাতীত বোঝা চাপান না।” (সূরা আল-বাকারা, ২:২৮৬)

অতএব, আপনার উপর যে কোনো কষ্ট বা বিপদ আসে, তা আপনার সহ্যসীমার বাইরে নয়। চূড়ান্ত ন্যায়বিচার কিয়ামতের দিন পূর্ণ হবে।

মু’মিনদের জন্য অধিক পরীক্ষা, কারণ জান্নাতের উচ্চ মর্যাদা

জান্নাত কোনো একক স্থান নয়, বরং এর রয়েছে বিভিন্ন স্তর ও মর্যাদা। আল্লাহর প্রিয় বান্দারা, যারা দুনিয়ার পরীক্ষায় অধিক ধৈর্য ও দৃঢ়তার পরিচয় দেয়, তারা জান্নাতে উচ্চ মর্যাদা লাভ করবে।

আল্লাহ বলেন:

“তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, অথচ তোমাদের কাছে এখনো তাদের মতো পরিস্থিতি আসেনি যারা তোমাদের পূর্বে চলে গেছে? তাদেরকে অভাব ও কষ্ট স্পর্শ করেছিল এবং তারা প্রকম্পিত হয়েছিল। এমনকি রাসূল ও তাঁর সাথের মুমিনরা বলে উঠেছিল, ‘আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে?’ জেনে রাখো, আল্লাহর সাহায্য নিকটেই।” (সূরা আল-বাকারা, ২:২১৪)

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:

“মানুষের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা হয় নবীদের উপর, এরপর তাদের পরে যারা সর্বাধিক সৎ, তারপর যারা তাদের পরে। মানুষের পরীক্ষা হয় তার দ্বীনের দৃঢ়তার অনুপাতে।” (সুনান তিরমিযী, হাদীস: ২৩৯৮)

এই হাদিস প্রমাণ করে, বিপদ-আপদ মু’মিনদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। মু’মিনের বিপদ যত বেশি হয়, আল্লাহর কাছে তার মর্যাদা তত বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছানোর সুযোগ করে দেন।

অদৃশ্য জান্নাতের ওপর বিশ্বাস

আল্লাহ তাঁর মু’মিন বান্দাদেরকে এমন এক জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা তারা চোখে দেখেনি। এই অদৃশ্য বিষয়ের প্রতি বিশ্বাসই একজন মু’মিনকে পার্থিব জীবনের সকল কষ্ট ও পরীক্ষার মুখে দৃঢ় থাকতে সাহায্য করে।

আল্লাহ বলেন:

“কিন্তু তারা ব্যতীত, যারা তওবা করেছে, বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং সৎকাজ করেছে। তারাই জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি সামান্যতম অবিচারও করা হবে না।” (সূরা মারইয়াম, ১৯:৬০)

“তা হচ্ছে স্থায়ী জান্নাত, যার ওয়াদা দয়াময় (আল্লাহ) তাঁর বান্দাদেরকে অদৃশ্যভাবে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই তাঁর ওয়াদা অবশ্যই পূর্ণ হবে।” (সূরা মারইয়াম, ১৯:৬১)

এই আয়াতগুলোর তাৎপর্য হচ্ছে, মু’মিনদের ঈমান ও ইয়াক্বীনের দৃঢ়তা এমন যে, তারা জান্নাত চোখে না দেখলেও আল্লাহর অদৃশ্য ওয়াদার ওপর ভরসা করে। এই ভরসাই তাদের সকল কষ্ট ও বিপদের মধ্যেও ঈমান ও আল্লাহ-ভীতির পথে অবিচল রাখে। এটিই সেই আসল কারণ, কেন আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের বেশি পরীক্ষা করেন।

ধৈর্য ধারণের পুরস্কার

বিপদে ধৈর্য ধারণ করা একজন মু’মিনের অন্যতম গুণ। এই ধৈর্য শুধু কষ্ট সহ্য করা নয়, বরং আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখা। ধৈর্যশীলদের জন্য রয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ পুরস্কার।

আল্লাহ বলেন:

“আর কত নবী ছিল, যাদের সাথে বহু সংখ্যক আল্লাহওয়ালা যুদ্ধ করেছে, কিন্তু আল্লাহর পথে তাদের যে বিপদ এসেছিল তাতে তারা সাহস হারায়নি, দুর্বল হয়ে যায়নি এবং তারা নতও হয়নি। আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের ভালোবাসেন।” (সূরা আল ইমরান, ৩:১৪৬)

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:

“যখন কোনো মুসলমান বিপদে পড়ে এবং বলে—’হে আল্লাহ! আমাকে আমার বিপদে ধৈর্য দাও এবং এর পরিবর্তে উত্তম কিছু দান করো,’ তাহলে আল্লাহ অবশ্যই তাকে উত্তম কিছু দিয়ে দেন।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৯১৮)

এই দো’আটি পড়লে বান্দা বিপদেও নেকি লাভ করে এবং আল্লাহ তার জন্য এমন কিছু নির্ধারণ করেন, যা তার কল্পনারও বাইরে।


আল্লাহ পৃথিবীতে কাউকে অকারণে কষ্ট দেন না। প্রতিটি কষ্ট, দুঃখ, ক্ষতি আসলে পরীক্ষা। এর মাধ্যমে আল্লাহ দেখতে চান:

  • কারা ধৈর্যশীল,
  • কারা সত্যিকার মু’মিন,
  • আর কারা বিপদে পড়ে হতাশ হয়ে যায়।

একজন মুসলিম যখন বিপদে পড়ে, তখন সে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখে এবং তার কাছে সাহায্য চায়। পক্ষান্তরে, একজন অবিশ্বাসী বা কাফির সহজে হতাশ হয়ে পড়ে এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর উপাসনা শুরু করে, যা ইসলামে একটি গুরুতর পাপ। আল্লাহ মানুষের আমল ও কাজের ভিত্তিতেই তাকে পুরস্কৃত করেন। এই পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি যাচাই করেন, কে তার পথে অবিচল থাকে।

অতএব, একজন মু’মিনের কর্তব্য হলো সবর (ধৈর্য) করা, আল্লাহর উপর ভরসা রাখা এবং কৃতজ্ঞ থাকা।

আল্লাহ আমাদেরকে প্রতিটি পরীক্ষায় সফল হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমীন।

প্রায়শঃ জিজ্ঞাসা (FAQ)

আল্লাহ কেন কষ্ট দেন?

কুরআনের ভাষায়—এটি পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় ধৈর্য ও সৎকর্মের মাধ্যমে মুমিনেরা উন্নীত হন।

বিপদে পড়লে প্রথমে কী করবো?

“ইন্না লিল্লাহি… রাজিঊন” পড়ুন, দুই রাকাআত নফল সালাত আদায় করুন, উপরের দু’আটি পড়ুন, ও সৎকাজে অবিচল থাকুন।

ধৈর্যের বিনিময় কী?

রহমত, হিদায়াত ও পরকালীন বড় প্রতিদান—জান্নাত। (আল-বাকারা ২:১৫৬–১৫৭)

ফেসবুকে যারা মন্তব্য করেছেনঃ
(Visited 37 times, 1 visits today)