ইসলাম মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত এক পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যার অবিচল ভিত্তি হলো পবিত্র কুরআন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বিশুদ্ধ হাদীস। এই দুটিই মুসলিম উম্মাহর পথনির্দেশিকা ও মুক্তির একমাত্র উপায়। তবে, অত্যন্ত দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, কালের পরিক্রমায় মুসলিম সমাজে মাযহাব বা দলীয় চিন্তার প্রভাব এতটাই গভীর হয়েছে যে, অনেক ক্ষেত্রে সহীহ হাদীসকেও অগ্রাহ্য করা হচ্ছে—কেবলমাত্র কোনো নির্দিষ্ট মাযহাবের মতের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে। অথচ চার ইমামের ‘আক্বীদাহ বিষয়ক আলোচনাগুলো প্রমাণ করে, তাঁদের নিজেদের কাছেও কুরআন ও সহীহ হাদীসই ছিল সর্বোচ্চ দলীল।
আল্লাহ ও রাসূলের সুস্পষ্ট নির্দেশনা
মহান আল্লাহ তা’আলা তাঁর কিতাবে এবং তাঁর রাসূল (সা.) তাঁর সুন্নাহয় আমাদের জন্য সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রেখে গেছেন। এ পথ অনুসরণ করলেই আমরা সঠিক পথে অবিচল থাকতে পারব।
আল্লাহ বলেন:
“তোমরা যা রাসূল তোমাদেরকে দেন তা গ্রহণ করো এবং যা থেকে নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাকো।” (সূরা হাশর: ৭)
রাসূল (সা.) বলেন:
“আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যদি তা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো, কখনো পথভ্রষ্ট হবে না: আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাহ।” (মুয়াত্তা মালিক)
এই আয়াত ও হাদীসদ্বয়ের আলোকে প্রশ্ন জাগে: যদি আমরা সত্যিই পরকালীন মুক্তি ও হেদায়েত চাই, তাহলে কুরআন ও সহীহ হাদীসের বাইরে অন্য কোনো কিছুর দিকে ঝুঁকে পড়ার সুযোগ কোথায়?
চার ইমামের হাদীস অনুসরণের গুরুত্ব
ইসলামী ফিকহের চার মহান ইমাম—ইমাম আবু হানিফা (রহ.), ইমাম মালিক (রহ.), ইমাম শাফিয়ী (রহ.) এবং ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)—সকলেই তাঁদের ইলমী জীবনে সহীহ হাদীস অনুসরণের ওপর অসীম গুরুত্বারোপ করেছেন। তাঁদের বক্তব্যগুলো অত্যন্ত স্পষ্ট এবং এক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যে সম্পূর্ণ ঐক্য বিদ্যমান ছিল:
- ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেন: “যদি আমার মতের বিরুদ্ধে সহীহ হাদীস পাওয়া যায়, তবে সেটিই আমার মাযহাব।”
- ইমাম মালিক (রহ.) বলেন: “আমি মানুষ মাত্র, ভুলও হতে পারে, সঠিকও হতে পারে। কুরআন ও সুন্নাহর সঙ্গে যা মিলে তা গ্রহণ করো, আর বাকি সব বর্জন করো।”
- ইমাম শাফিয়ী (রহ.) বলেন: “আমার যেকোনো কথা যদি রাসূল (সা.)-এর হাদীসের বিপরীত হয়, তবে রাসূলের কথাই গ্রহণযোগ্য।”
- ইমাম আহমদ (রহ.) বলেন: “সাহাবীদের কথা শরীয়তের দলীল হতে পারে, কিন্তু ইমামদের অভিমত নয়।”
এই উক্তিগুলো প্রমাণ করে যে, চার ইমাম কেউই তাঁদের ব্যক্তিগত ইজতিহাদ বা মতামতকে চূড়ান্ত মনে করেননি। বরং, তাঁরা সকলে কুরআন ও সহীহ হাদীসকেই ইসলামের চূড়ান্ত দলীল হিসেবে গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁদের নিজেদের ‘আক্বীদাহও ছিল কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, যা তাঁদের মধ্যে গভীর ঐক্য নিশ্চিত করেছিল।
কেন সহীহ হাদীস অগ্রাহ্য করা হয়?
চার ইমামের এই স্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও, কিছু কারণে সহীহ হাদীস অগ্রাহ্য বা বর্জন করার প্রবণতা দেখা যায়:
১. অন্ধ মাযহাব অনুসরণ (তাক্বলীদ): অনেক মুসলিম শৈশব থেকেই একটি নির্দিষ্ট মাযহাবের অনুসারী হিসেবে বেড়ে ওঠেন, যেমন—”আমরা হানাফী”, “আমরা শাফেয়ী”। এর ফলে, মাযহাবের প্রচলিত মতামতের বাইরে কোনো সহীহ হাদীস পেলে তারা সেটিকে সন্দেহের চোখে দেখে বা প্রত্যাখ্যান করে।
২. দলীয় গোঁড়ামি: নিজেদের দল বা মতকে সঠিক প্রমাণ করার জন্য অনেক সময় হাদীসের অর্থ বিকৃতি, বা কোনো সহীহ হাদীসকে ‘দুর্বল’ বলার প্রবণতা দেখা যায়, যা ইসলামে অনভিপ্রেত।
৩. সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা: অধিকাংশ মানুষের কুরআন ও সহীহ হাদীস সম্পর্কে গভীর জ্ঞান না থাকার কারণে তারা শুধুমাত্র তাদের এলাকার প্রচলিত মাযহাব বা পীর-মুর্শিদের মতেই আস্থা রাখে, যা জ্ঞান অর্জনের মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত করে।
প্রকৃত মাযহাব: কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ
চার ইমামের প্রকৃত মাযহাব একটাই ছিল—কুরআন ও সহীহ হাদীসের নির্ভুল অনুসরণ। কিন্তু তাঁদের মৃত্যুর পর, তাঁদের ভক্ত ও অনুসারীরা তাঁদের ইজতিহাদ ও মতামতসমূহকে চূড়ান্ত বলে ধরে নিতে থাকেন। কালের পরিক্রমায় এই ইজতিহাদসমূহ স্বতন্ত্র মাযহাবের রূপ ধারণ করে। এটি লক্ষণীয় যে, আল্লামা শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী (রহ.) এর মতানুসারে, হিজরী ৪০০ সালের আগ পর্যন্ত কোনো একক ইমামের মাযহাব অনুসরণ বাধ্যতামূলক ছিল না।
চার মাযহাব মানা কি ফরজ?
কুরআন-হাদীসের কোথাও চার মাযহাব অনুসরণ করাকে ফরজ বা ওয়াজিব বলা হয়নি। এমনকি রাসূল (সা.) ও সাহাবাগণের যুগেও কোনো নির্দিষ্ট মাযহাবের ধারণা ছিল না।
রাসূল (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন:
“আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে, একটি দল ছাড়া বাকিগুলো জাহান্নামে যাবে। তারা হলো, যারা আমার ও আমার সাহাবীদের পথ অনুসরণ করবে।” (আবু দাউদ) এই হাদীস থেকে স্পষ্ট হয় যে, বিভেদ নয়, বরং রাসূল (সা.) ও তাঁর সাহাবীদের পথ অনুসরণ করাই মুক্তির একমাত্র উপায়।
আমাদের করণীয়
মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সঠিক পথে ফিরে আসার জন্য আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মেনে চলতে হবে:
- কুরআন ও সহীহ হাদীসকে সরাসরি বুঝে আমল করার চেষ্টা করতে হবে।
- ইমামদের প্রতি গভীর সম্মান থাকবে, কিন্তু তাঁদের অন্ধ অনুসরণ নয়।
- কোনো মত বা ফতোয়া যদি সুস্পষ্ট সহীহ হাদীসের বিপরীত হয়, তবে তা বর্জন করতে হবে।
ইসলামের পথ একটাই—রাসূল (সা.) ও তাঁর সাহাবীদের পথ, যা কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ দ্বারা আলোকিত। দলীয় বিভক্তি, অন্ধ মাযহাব অনুসরণ, বা সহীহ হাদীস বর্জন কেবল আমাদের ধ্বংসের পথেই ঠেলে দেয়। আসুন, চার ইমামের প্রকৃত আদর্শকে হৃদয়ে ধারণ করি—কুরআন ও সহীহ হাদীসকে একমাত্র মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করি এবং সত্যিকার অর্থে “মুসলিম” পরিচয় ধারণ করে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরি।
আপনি চাইলে এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে পারেন নিচের গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো পড়ে:
📥 বইগুলো ডাউনলোড করুন:
[raw]
[one_third]

[/one_third]
[one_third]


[/one_third]
[one_third last]

[/one_third]
[clear]
[/raw]
বইটা পিডিয়েফ বাংলা ভারসান কী ভাবে ডাউনলোডকরবো
যে বইটি ডাউনলোড করতে চান সে বইটির ছবির উপর মাউস ক্লিক করুন।