মানুষের দুনিয়াবি জীবন আসলে এক পরীক্ষার ময়দান। আল্লাহ তাআলা বান্দাদের পরীক্ষা করেন—কে তাঁর আনুগত্য করবে আর কে তাঁর অবাধ্য হবে। এই পরীক্ষার জন্য আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন নানা উপকরণ; তার মধ্যে অন্যতম হলো শয়তান এবং তার ভয়াবহতম প্রেরিত প্রতিনিধি মাসীহ দাজ্জাল। ইতিহাসে প্রতিটি নবী তাঁর উম্মতকে দাজ্জালের ফিতনা থেকে সতর্ক করেছেন।


মাসীহ দাজ্জাল কে?

মাসীহ শব্দটি আরবি মাসাহা থেকে এসেছে, যার অর্থ “আশীর্বাদপ্রাপ্ত” বা “স্পর্শকৃত”।
দাজ্জাল শব্দের অর্থ “প্রতারক” বা “মিথ্যাবাদী”।
দুটো মিলিয়ে অর্থ দাঁড়ায়—আশীর্বাদপ্রাপ্ত প্রতারক

আসলে দাজ্জাল হবে শয়তানের বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি। তাকে এমন অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা দেয়া হবে যা মানুষের ইতিহাসে শুধু ফেরেশতাদেরই ছিল—যেমন আকাশ থেকে বৃষ্টি নামানো, জমিনে ফসল উৎপাদন করানো ইত্যাদি। প্রথমে সে নিজেকে নবী দাবি করবে, পরে নিজেকে “প্রভু” বা “ইলাহ” বলে ঘোষণা করবে এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করবে।


দাজ্জালের শারীরিক বৈশিষ্ট্য (সহিহ হাদিস অনুযায়ী)

রাসূলুল্লাহ ﷺ দাজ্জালের স্পষ্ট বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন, যেন মুসলিমরা তাকে চিনতে পারে—

  • বয়সে যুবক, গায়ের রং সাদা-লালচে
  • খাটো উচ্চতা, ঘন কোঁকড়ানো চুল, চওড়া কপাল
  • ডান চোখ বা বাম চোখ—যে কোনো এক চোখ মারাত্মক ত্রুটিযুক্ত, যেন ভাসমান আঙুরের মতো
  • দুই চোখের মাঝে “ك ف ر” (কাফির) লেখা থাকবে, যা প্রতিটি মুমিন পড়তে পারবে
  • বন্ধ্যা হবে, তার কোনো সন্তান থাকবে না

হাদিস রেফারেন্স: সহিহ বুখারি 7026, সহিহ মুসলিম 7095, 7100, 7106, 7253, সুনান আবু দাউদ 4269 ইত্যাদি


দাজ্জালের আবির্ভাব কোথা থেকে হবে?

সহিহ হাদিসে এসেছে—

  • সে ইহুদিদের মধ্য থেকে বের হবে এবং তার অধিকাংশ অনুসারী হবে ইহুদী
  • ইরানের ইস্ফাহান শহরের ইহুদি জনপদ থেকে তার উদ্ভব ঘটবে
  • শেষ পরিণতিতে ইসরাইলের লুদ শহরে তাকে হত্যা করবেন হযরত ঈসা (আঃ)

ইতিহাস বলছে, ইস্ফাহান শহর প্রাচীনকাল থেকেই ইহুদিদের বসতি। বর্তমানে ইসরাইলে বিপুলসংখ্যক ইরানি ইহুদি বাস করে—যা দাজ্জালের হাদিসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।


দাজ্জালের সময়কাল

হাদিসে এসেছে—

  • মোট ৪০ দিন পৃথিবীতে অবস্থান করবে
  • ১ম দিন হবে ১ বছরের সমান, ২য় দিন ১ মাসের সমান, ৩য় দিন ১ সপ্তাহের সমান, বাকিগুলো স্বাভাবিক দিনের মতো
  • প্রথম দিনের দীর্ঘতায় নামাজ সময় হিসাব করে আদায় করতে হবে (সহিহ মুসলিম 2937)

দাজ্জালের ভয়াবহ ফিতনা

দাজ্জালের ফিতনা হবে আদম (আঃ) থেকে কেয়ামত পর্যন্ত সবচেয়ে বড় ফিতনা। তার কিছু অলৌকিক কাজ—

  • তার কাছে থাকবে “জান্নাত” ও “জাহান্নাম” — আসলে উল্টো হবে; তার জান্নাত হবে প্রকৃত জাহান্নাম
  • আকাশে বৃষ্টি বর্ষণের নির্দেশ দিবে, সাথে সাথে বৃষ্টি নামবে
  • জমিনে ফসল ফলানোর আদেশ দিবে, সাথে সাথে ফল-ফসল উৎপন্ন হবে
  • পাহাড়সম রুটি ও পানির নদী থাকবে
  • ভূমির গুপ্তধন তার ডাকে বের হয়ে আসবে
  • বাতাসে মেঘের মতো দ্রুত চলাফেরা করবে

হাদিস রেফারেন্স: সহিহ মুসলিম 2937, 7100, 7101


দাজ্জাল থেকে বাঁচার উপায়

রাসূলুল্লাহ ﷺ কয়েকটি করণীয় শিখিয়েছেন—

  1. সূরা কাহফের প্রথম ১০ আয়াত মুখস্থ রাখা ও পড়া (সহিহ মুসলিম 809)
  2. তার ফিতনার খবর জেনে সতর্ক থাকা
  3. মদীনায় বা মক্কায় অবস্থান—দাজ্জাল সেখানে প্রবেশ করতে পারবে না
  4. আল্লাহর কাছে তার ফিতনা থেকে আশ্রয় চাওয়া

শেষ পরিণতি: লুদ শহর

হাদিসে এসেছে—
হযরত ঈসা (আঃ) দামেস্কে অবতীর্ণ হয়ে দাজ্জালকে ধাওয়া করবেন এবং ইসরাইলের লুদ শহরের ফটকে তাকে হত্যা করবেন। এরপর দাজ্জালের ফিতনার অবসান হবে এবং পৃথিবীতে শান্তি নেমে আসবে।


দাজ্জালের ফিতনা এত ভয়ংকর যে প্রতিটি নবী তাঁর উম্মতকে এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি ও সহিহ হাদিসের বর্ণনা মিলিয়ে বলা যায়—তার আবির্ভাব ঘনিয়ে এসেছে। মুসলিম হিসেবে আমাদের উচিত—ইমান শক্ত রাখা, আল্লাহর সাহায্য চাওয়া, সহিহ হাদিস জানা ও দাজ্জালের ফিতনা থেকে বাঁচার প্রস্তুতি নেওয়া

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে এই মহাফিতনা থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

ফেসবুকে যারা মন্তব্য করেছেনঃ
(Visited 9 times, 1 visits today)