মানুষ স্বভাবতই ভুল করে। পাপ ও ত্রুটি-বিচ্যুতি মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু মহান আল্লাহ তা’আলা পরম দয়ালু ও ক্ষমাশীল। তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য ক্ষমা চাওয়ার এক সহজ ও কার্যকর উপায় বাতলে দিয়েছেন, আর তা হলো ‘ইস্তিগফার’। ইস্তিগফার কেবল পাপমোচনের মাধ্যমই নয়, এটি আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ককে সুদৃঢ় করে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে অগণিত কল্যাণ বয়ে আনে। এই প্রবন্ধে আমরা জানব ইস্তিগফার কী, কেন আমরা ইস্তিগফার করব, এর অসাধারণ উপকারিতাগুলো কী কী, বিভিন্ন প্রকার ইস্তিগফার এবং কখন ও কীভাবে এটি করলে সর্বাধিক সাওয়াব লাভ করা যায়।
ইস্তিগফার কী?
ইস্তিগফার (اِسْتِغْفَار) শব্দটি আরবি ‘গাফার’ মূল থেকে এসেছে, যার আভিধানিক অর্থ হলো ক্ষমা চাওয়া বা প্রভুর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা। ইসলামী পরিভাষায়, ইস্তিগফার বলতে বোঝায় বান্দার পূর্বকৃত পাপ ও ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহ তা’আলার নিকট আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করা। এই ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমেই মানুষ তার প্রভুর নিকট মর্যাদাবান ও গ্রহণযোগ্য বান্দা হয়ে ওঠে।
আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.) নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও সবচেয়ে বেশি ইস্তিগফার করতেন এবং তাঁর উম্মতদেরও বেশি বেশি ইস্তিগফার করার জন্য উৎসাহিত করতেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ❝আল্লাহর ক্বসম! আমি দিনের মধ্যে ৭০ বারেরও অধিক ইস্তিগফার করি (আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই) এবং তাওবাহ করি।❞ (সহীহ বুখারী: ৬৩০৭)
কেন ইস্তিগফার করব? (গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা)
ইস্তিগফার একজন মুসলিমের জীবনের একটি অপরিহার্য আমল। এর গুরুত্ব বহুবিধ:
- আল্লাহর আদেশ: কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা’আলা অসংখ্যবার তাঁর বান্দাদের ক্ষমা চাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এটি আল্লাহর নির্দেশ পালন এবং তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশের একটি মাধ্যম।
- পাপমোচন: মানুষ হিসেবে আমাদের ভুল-ত্রুটি হওয়া স্বাভাবিক। ইস্তিগফারের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন, এমনকি বড় বড় গুনাহও।
- নবীজির সুন্নাহ: রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর নিষ্পাপ জীবন সত্ত্বেও প্রতিদিন অসংখ্যবার ইস্তিগফার করতেন, যা উম্মতের জন্য এক মহান আদর্শ।
- আল্লাহর ভালোবাসা: আল্লাহ তা’আলা তাদের ভালোবাসেন যারা তাঁর কাছে বারবার ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং তওবা করে।
- হৃদয়ের শান্তি: আল্লাহর স্মরণ ও তাঁর কাছে ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে অন্তর প্রশান্ত হয় এবং মানসিক চাপ ও অস্থিরতা দূর হয়। আল্লাহ বলেন: ❝শুধু আল্লাহর স্মরণেই তোমার অন্তর শান্তি পাবে।❞ (সূরা রাদ: ২৮)
- জান্নাতের পথ: ইস্তিগফার নিয়মিত আমলকারীর জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে।
ইস্তিগফারের উপকারিতা ও সুফলসমূহ
ইস্তিগফার শুধু গুনাহ মাফই করে না, এর বহুবিধ দুনিয়াবী ও আখিরাতের উপকারিতা রয়েছে, যা কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:
- প্রচুর বৃষ্টি ও বরকত: আল্লাহ তা’আলা বলেন: ❝আমি বলেছি, তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, নিঃসন্দেহে তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত করবেন। তিনি তোমাদের সম্পদ, সন্তান দিয়ে সমৃদ্ধ করবেন এবং তোমাদের জন্য উদ্যান ও প্রবাহিত নদ-নদী স্থাপন করবেন।❞ (সূরা নূহ: ১০-১২)
- উত্তম সন্তান, সম্পদ ও জীবিকা: ইস্তিগফারকারীকে আল্লাহ উত্তম সন্তান, সম্পদ ও হালাল জীবিকা দ্বারা সম্মানিত করেন এবং তাকে উপভোগ্য জীবন দান করেন।
- দুশ্চিন্তা ও পেরেশানি দূর: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ❝যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার পাঠ করে, আল্লাহ তা’আলা তাকে সর্বপ্রকার বিপদাপদ হতে মুক্ত করবেন, সবরকম দুশ্চিন্তা হতে রক্ষা করবেন এবং তার জন্য এমন স্থান থেকে রিজিকের ব্যবস্থা করবেন, যা সে কল্পনাও করতে পারে না।❞ (সুনানে আবু দাউদ: ১৫১৮)
- সংকট থেকে উত্তরণ: ইস্তিগফারের মাধ্যমে আল্লাহ সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুলে দেন।
- অকল্পনীয় রিযিকের ব্যবস্থা: বেকারত্ব দূর হয় এবং অপ্রত্যাশিত উৎস থেকে জীবিকার ব্যবস্থা হয়।
- আল্লাহর ভালোবাসা ও নৈকট্য: নিয়মিত ইস্তিগফারকারীর প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট হন এবং তাঁর নৈকট্য অর্জিত হয়। হাদীসে এসেছে, ইবলীস আল্লাহর কাছে মানুষকে পথভ্রষ্ট করার শপথ নিলে, আল্লাহ বলেন: ❝আমি আমার সম্মান-প্রতিপত্তির শপথ করে বলছি, আমি তাদেরকে ক্ষমা করতে থাকব যতক্ষণ তারা আমার কাছে ক্ষমা চাইতে থাকবে।❞ (মুসনাদে আহমাদ: ৩/২৯)
- দ্বীন পালনে সহজতা: ইস্তিগফার দ্বীন পালনকে সহজ করে এবং কর্মজীবনকে সুখের করে তোলে।
- গুনাহ মাফ: আল্লাহ ও বান্দার মাঝে যে দূরত্ব থাকে, ইস্তিগফারের মাধ্যমে তা কমে যায় এবং সকল গুনাহ ক্ষমা হয়।
- ঈমানের স্বাদ আস্বাদন: ইস্তিগফার অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে এবং ঈমানের প্রকৃত স্বাদ উপলব্ধিতে সাহায্য করে।
- বিচক্ষণতা ও বিশ্বাস বৃদ্ধি: ইস্তিগফারকারীর জ্ঞান ও বিশ্বাসে প্রবৃদ্ধি আসে।
- মৃত্যুর সময় সুসংবাদ: মৃত্যুর সময় ফেরেশতারা ইস্তিগফারকারীর জন্য সুসংবাদ নিয়ে আসেন।
- হাশরের মাঠে আরশের ছায়া: কিয়ামতের দিন যখন মানুষ প্রচণ্ড গরম ও ঘামের মধ্যে থাকবে, ইস্তিগফারকারী আল্লাহর আরশের ছায়াতলে আশ্রয় পাবে।
- ডানপন্থী মুত্তাকীনদের অন্তর্ভুক্ত: কিয়ামতের দিন মানুষ যখন অস্থির থাকবে, ইস্তিগফারকারী তখন ডানপন্থী মুত্তাকীনদের দলে থাকবে।
- মন্দ কাজ থেকে সুরক্ষা: ইস্তিগফার মানুষকে মন্দ কাজ থেকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে।
- ফেরেশতাদের দোয়া: আরশ বহনকারী ফেরেশতারাও ইস্তিগফারকারীর জন্য দোয়া করেন।
ইস্তিগফার কীভাবে করব? (বিভিন্ন প্রকার ও মাসনুন দোয়া)
ইস্তিগফার যেকোনো শব্দেই করা যায়, যেমন – ❝ইয়া আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করে দিন!❞ বলে দু’আ করলেও হবে। তবে, রাসূলুল্লাহ (সা.) যে বাক্যগুলোতে ইস্তিগফার করেছেন, সেই মাসনুন বাক্যগুলোতে ক্ষমা চাওয়া নিঃসন্দেহে অতি উত্তম এবং অধিক সাওয়াবপূর্ণ। নিচে হাদীসে বর্ণিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্তিগফারের দোয়া উল্লেখ করা হলো:
১. সহজ ইস্তিগফার:
আরবি: أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ
উচ্চারণ: আস্তাগফিরুল্লাহ।
অর্থ: আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
ফজিলত: রাসূল (সা.) নামাজ শেষে ৩ বার এটি বলতেন। (মুসনাদে আহমদ: ২২৪০৮)
২. তাওবাসহ ইস্তিগফার (১):
আরবি: أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ
উচ্চারণ: আস্তাগফিরুল্লাহ ওয়া আতূবু ইলাইহি।
অর্থ: আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাচ্ছি এবং তাঁর নিকট তাওবাহ্ করছি।
ফজিলত: আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, ❝আমি রাসূল (সা.)-এর চাইতে কাউকে অধিক এই ইস্তিগফার বলতে শুনিনি – ‘আস্তাগফিরুল্লাহ ওয়া আতূবু ইলাইহি’!❞ (নাসায়ী কুবরা: ১০২১৫, হাদীসটি বিশুদ্ধ)
৩. তাওবাসহ ইস্তিগফার (২) – (জিহাদ থেকে পলায়নকারীর জন্যও ক্ষমা):
আরবি: أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ الَّذِي لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ
উচ্চারণ: আসতাগফিরুল্লা হাল্লাযি লা ইলাহা ইল্লা হুওয়াল ‘হাইয়ুল ক্বাইয়ূমু ওয়া আতূবু ইলাইহি।
অর্থ: আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি, যিনি ব্যতীত কোনো সার্বভৌম সত্তা নেই—তিনি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী—এবং আমি তাঁর নিকট তাওবাহ্ করছি।
ফজিলত: রাসূল (সা.) বলেছেন, ❝যে ব্যক্তি এই দু’আ পাঠ করবে তার গুনাহ্ ক্ষমা করে দেওয়া হবে—যদিও সে জিহাদের ময়দান থেকে পলায়নকারী হয়।❞ (আবু দাউদ: ১৫১৭, তিরমিযি: ৩৫৭৭, হাদীসটি বিশুদ্ধ)
- অন্য বর্ণনায় এসেছে, ❝আসতাগফিরুল্লাহাল ‘আযীম, আল্লাযি… (বাকি অংশে কোনো পরিবর্তন নেই)।❞ (তিরমিযি: ৩৫৭৭, হাসান)
৪. ‘রাব্বিগফিরলি’ ইস্তিগফার:
আরবি: رَبِّ اغْفِرْ لِي وَتُبْ عَلَيَّ إِنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ
উচ্চারণ: রাব্বিগফিরলি ওয়া তুব ‘আলাইয়া, ইন্নাকা আনতাত তাওয়াবুর রাহীম।
অর্থ: হে আমার রব! আমাকে ক্ষমা করুন; আমার তাওবাহ্ কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি তাওবাহ্ কবুলকারী পরম দয়াময়।
ফজিলত: ইবনু উমার (রা.) বলেন, আমরা গুণে দেখতাম যে, নবী করীম (সা.) একই মজলিসে ১০০ বার পর্যন্ত এটি পাঠ করছেন। (তিরমিযি: ৩৪৩৪, আবু দাউদ: ১৫১৬, হাদীসটি বিশুদ্ধ)
৫. সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সহ ইস্তিগফার:
আরবি: سُبْحَانَ اللَّهِ وَبِحَمْدِهِ أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ
উচ্চারণ: সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি, আসতাগফিরুল্লাহা ওয়া আতূবু ইলাইহি।
অর্থ: আমি আল্লাহর প্রশংসাসহ পবিত্রতা ঘোষণা করছি। আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তাঁর নিকট তাওবাহ্ করছি।
ফজিলত: রাসূলুল্লাহ (সা.) ইন্তিকালের আগেও এটি অনেকবার পাঠ করেছেন। (সহীহ মুসলিম: ৪৮৪, রিয়াদুস সালেহীন: ১৮৮৬)
৬. সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার (ইস্তিগফারের নেতা): এটি ইস্তিগফারসমূহের মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ।
আরবি: اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ، خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ، وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ، أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ، أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ، وَأَبُوءُ لَكَ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي، إِنَّهُ لاَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلاَّ أَنْتَ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা আনতা রাব্বী লা-ইলাহা ইল্লা আনতা, খালাক্বতানী ওয়া আনা ‘আবদুকা, ওয়া আনা ‘আলা ‘আহ্দিকা ওয়া ওয়া’দিকা মাসতা ত’তু আ’উযুবিকা মিন শাররি মা সনা’তু আবূ-উ লাকা বিনি’মাতিকা ‘আলাইয়া ওয়া আবূ-উ বিযানবী, ফাগফিরলি ফা ইন্নাহু লা-ইয়াগফিরুয যুনূবা ইল্লা আনতা।
অর্থ: হে আল্লাহ! তুমিই আমার রব। তুমি ছাড়া কোনো সার্বভৌম সত্তা নেই। তুমিই আমাকে সৃষ্টি করেছো আর আমি তোমারই গোলাম। তুমি আমার কাছ থেকে যে অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি নিয়েছো, সাধ্যানুযায়ী আমি তার ওপর চলবো। আমি আমার কৃতকর্মের অনিষ্ট থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই। তুমি আমার প্রতি তোমার যে নিয়ামত দিয়েছো তা স্বীকার করছি এবং আমার গুনাহের কথাও স্বীকার করছি। অতএব, তুমি আমাকে মাফ করে দাও। কারণ তুমি ছাড়া কেউ গুনাহ ক্ষমা করতে পারে না।
ফজিলত: রাসূল (সা.) বলেন, ❝যে ব্যক্তি দিনের বেলায় এ দু’আটি দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে পড়বে, অতঃপর সেদিন সন্ধ্যা হওয়ার আগেই মারা যাবে, সে জান্নাতীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। আর যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে এটি পড়বে, অতঃপর সকাল হওয়ার আগেই মারা যাবে, সে জান্নাতীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।❞ (সহীহ বুখারী: ৬৩০৬)
৭. মজলিস শেষে ইস্তিগফার (কাফফারা):
আরবি: سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ، أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْكَ
উচ্চারণ: সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বি‘হামদিকা আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লা আনতা আস্তাগফিরুকা ওয়া আতূবু ইলাইকা।
অর্থ: হে আল্লাহ! তুমি পবিত্র; প্রশংসা কেবল তোমারই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি—তুমি ছাড়া কোনো সার্বভৌম সত্তা নেই। আমি তোমার নিকট ক্ষমা চাচ্ছি এবং তোমার নিকট তাওবাহ্ করছি।
ফজিলত: নবী করীম (সা.) বলেছেন, ❝যে ব্যক্তি এমন কোনো মজলিসে বসলো, যেখানে সে অনর্থক অনেক কথা বলেছে, সে যদি ওই মজলিস থেকে ওঠার আগেই এই দু’আটি বলে, তবে আল্লাহ্ তার ওই মজলিসের বিষয়াদির কাফফারা (প্রায়শ্চিত্য) করে দেবেন।❞ (তিরমিযি: ৩৪৩৩, হাসান সহীহ গরীব)
- এই দু’আটিতে আল্লাহর প্রশংসা, পবিত্রতা, শাহাদাহ—সবই আছে, ফলে কবুল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
৮. নামাজের ভেতরের ইস্তিগফার (রুকু ও সিজদায়):
আরবি: سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ رَبَّنَا وَبِحَمْدِكَ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي
উচ্চারণ: সুবহানাকা আল্লাহুম্মা রাব্বানা ওয়া বিহামদিকা, আল্লাহুম্মাগফিরলী।
অর্থ: হে আমাদের রব—আল্লাহ! আপনি মহান; প্রশংসা কেবল আপনারই। হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করুন।
ফজিলত: আয়িশা (রা.) বলেন, কুরআনের নির্দেশ (সূরা আন-নাসরের অনুবাদ দেখুন) অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ (সা.) রুকু ও সিজদায় গিয়ে এই ইস্তিগফারটি পড়তেন। (বুখারী: ৭৯৪)
৯. দুই সিজদার মাঝে ইস্তিগফার:
আরবি: رَبِّ اغْفِرْ لِي رَبِّ اغْفِرْ لِي
উচ্চারণ: রাব্বিগফিরলি, রাব্বিগফিরলি।
অর্থ: হে আমার রব! আমাকে ক্ষমা করুন। হে আমার রব! আমাকে ক্ষমা করুন।
ফজিলত: নবী করীম (সা.) দুই সিজদার মাঝে বসা অবস্থায় এটি পড়তেন। (সহীহ মুসলিম: ৭৭২)
১০. নামাজের শেষ বৈঠকে ইস্তিগফার (দু’আ মাসূরা):
اللَّهُمَّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي ظُلْمًا كَثِيرًا، وَلاَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلاَّ أَنْتَ، فَاغْفِرْ لِي مَغْفِرَةً مِّنْ عِنْدِكَ، وَارْحَمْنِي، إِنَّكَ أَنْتَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নী যলামতু নাফসী যুলমান কাসীরান, ওয়ালা ইয়াগফিরুয যুনূবা ইল্লা আনতা, ফাগফিরলী মাগফিরাতাম মিন ইনদিকা, ওয়ারহামনী, ইন্নাকা আনতাল গাফূরুর রাহীম।
অর্থ: হে আল্লাহ্! আমি (গুনাহ করার মাধ্যমে) নিজের উপর অনেক জুলুম করেছি; তুমি ছাড়া অন্য কেউ গুনাহ ক্ষমা করতে পারে না। অতএব, তোমার পক্ষ থেকে আমাকে পরিপূর্ণভাবে ক্ষমা করো এবং আমার উপর দয়া করো। তুমি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
ফজিলত: আবু বকর (রা.) রাসূল (সা.)-কে বলেছিলেন একটি দু’আ শিখিয়ে দিতে, যা তিনি নামাজে পড়বেন। তখন নবী করীম (সা.) এটি শিখিয়ে দেন, যা দু’আ মাসূরা নামে পরিচিত। এটি নামাজের শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ ও দরুদের পর পড়বেন। (সহীহ বুখারী: ৮৩৪)
- এটি কেবল নামাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং যেকোনো সময় পড়া যায়।
১১. নামাজে সালাম ফেরানোর আগে ইস্তিগফার:
اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي مَا قَدَّمْتُ وَمَا أَخَّرْتُ وَمَا أَسْرَرْتُ وَمَا أَعْلَنْتُ وَمَا أَسْرَفْتُ وَمَا أَنْتَ أَعْلَمُ بِهِ مِنِّي
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাগফিরলি মা ক্বাদ্দামতু ওয়া-মা আখখারতু, ওয়া-মা আসরারতু ওয়া-মা আ’লানতু, ওয়া-মা আসরাফতু, ওয়া-মা আনতা আ’লামু বিহি মিন্নী।
অর্থ: হে আল্লাহ্, আমি আগে-পরে যত গুনাহ করেছি, তা মাফ করে দাও। যেসব গুনাহ গোপনে করেছি এবং যেগুলো প্রকাশ্যে করেছি (সব) মাফ করে দাও। যত বাড়াবাড়ি করেছি, সেগুলো ক্ষমা করে দাও এবং যেগুলো তুমি আমার চেয়ে ভালো জানো, সেগুলোও মাফ করে দাও।
ফজিলত: নবী করীম (সা.) নামাজে সালাম ফেরানোর আগে এই দু’আটি পড়তেন। (সহীহ বুখারী: ৬৩৯৮)
কখন ইস্তিগফার করবেন? (সর্বোত্তম সময়)
ইস্তিগফার যেকোনো সময় করা যায়, তবে কিছু বিশেষ সময়ে এর ফজিলত অনেক বেশি:
- প্রতিদিন ও প্রতি রাতে: রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজেও নিয়মিত ইস্তিগফার করতেন।
- সকাল ও সন্ধ্যায়: সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার সকাল ও সন্ধ্যায় পাঠের বিশেষ ফজিলত রয়েছে।
- নামাজ শেষে: প্রত্যেক ফরয নামাজের পর ৩ বার ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ বলা সুন্নাহ।
- কোনো গুনাহ করার পর: ভুল হয়ে গেলে তাৎক্ষণিকভাবে তওবাসহ ইস্তিগফার করা উচিত।
- মজলিস বা বৈঠক শেষে: অনর্থক কথাবার্তা বা ভুলের কাফফারা হিসেবে মজলিস শেষে দু’আ পড়া।
- ভোর রাতে (শেষ রাতে): এই সময় আল্লাহ তা’আলা নিকটবর্তী আসমানে নেমে আসেন এবং বান্দার ক্ষমা প্রার্থনা কবুল করেন।
- যেকোনো দুশ্চিন্তা বা সংকটে: যখনই কোনো বিপদ বা পেরেশানি আসে, ইস্তিগফার সাহায্য করে।
- মৃত ব্যক্তির জন্য: মৃত ব্যক্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা।
ইস্তিগফার একজন মুমিনের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি শুধু পাপমোচনের পথ নয়, বরং আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ককে গভীর করার এক কার্যকর মাধ্যম। ইস্তিগফারের মাধ্যমে আমরা দুনিয়া ও আখিরাতের অগণিত কল্যাণ লাভ করতে পারি, আমাদের অন্তর প্রশান্ত হয় এবং আমরা আল্লাহর অসীম রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় লাভ করি। আসুন, আমাদের প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে ইস্তিগফারকে জুড়ে দেই এবং আল্লাহর কাছে নিয়মিত ক্ষমা প্রার্থনা করে তাঁর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জন করি। আল্লাহ আমাদের সকলকে নিয়মিত ইস্তিগফার করার তাওফিক দান করুন। আমিন।