বৈবাহিক বিচ্ছেদ ও কুরআনিক দিকনির্দেশনা
তালাক, যা আমাদের সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ অর্থে প্রচলিত, মুসলিম পারিবারিক জীবনে এক সংবেদনশীল ও জটিল বিষয়। প্রায়শই এই ধারণা প্রচলিত যে, তালাক কেবল মুখে উচ্চারণের একটি বিষয়, যার তাৎক্ষণিক প্রভাবে বিবাহ সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু আল কুরআনে তালাকের যে বিধি-বিধান দেওয়া হয়েছে, তাতে তালাক শুধু মুখের কথা নয়, বরং এটি একটি সুনির্দিষ্ট আইনগত ও নৈতিক প্রক্রিয়া, যা সুচিন্তিতভাবে পরিচালিত হওয়া আবশ্যক।
আল কুরআনের আলোকে সঠিক উপলব্ধির অভাবে তালাক সংক্রান্ত বিধি-বিধান যথাযথভাবে পরিপালন করা হয় না, যার ফলস্বরূপ পরিবার ও সমাজে ব্যাপক সংকট সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) রিপোর্ট অনুসারে গত এক দশকে বাংলাদেশে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের রেকর্ড অনুযায়ী, বিগত ছয় বছরে প্রায় ৫০,০০০ তালাকের আবেদন জমা পড়েছে, অর্থাৎ প্রতি এক ঘণ্টায় একটি আবেদন। মনোবিজ্ঞানীদের স্ট্রেস স্কেল অনুযায়ী, বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে মানসিক পীড়নের মাত্রা মানুষের জীবনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মানসিক অশান্তির কারণ।
এই ব্লগ পোস্টটির লক্ষ্য হলো আল কুরআনের আলোকে তালাকের প্রকৃত বিধি-বিধান সম্পর্কে আলোকপাত করে বিশ্বপ্রভুর বিধান জানা ও মানার অনুপ্রেরণা দেওয়া। এর মাধ্যমে আমরা ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণের পথ অবলম্বন করতে পারব। এই আলোচনাটি সমাজকর্মী, আইনজ্ঞ, আইন বিভাগের অধ্যাপক, অধ্যয়নশীল শিক্ষার্থীবৃন্দ, আইনজীবি, নারী অধিকার বিষয়ে কর্মরত বিভিন্ন সংগঠন, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি, আইন প্রণয়নে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ এবং বিশেষত যেসব নারী-পুরুষ সংসার জীবনে কোনো তিক্ততার কারণে তালাকের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন, তাদের সকলের জন্য উপযোগী।
আল কুরআন, স্রষ্টার পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য নাযিল করা সার্বজনীন মহাবিধান, যেখানে নারীর অধিকার রক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মানুষকে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সভ্য আচরণের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এই আলোচনায় কুরআনের একক ও প্রশ্নাতীত কর্তৃত্বকে তুলে ধরা হয়েছে, কারণ কুরআনের বিশুদ্ধতা প্রশ্নাতীত এবং এটি যুগ ও স্থানের উর্ধ্বে একটি সার্বজনীন বিধান।
এক নজরে মূল প্রতিপাদ্য: প্রচলিত ভুল ও কুরআনের নির্দেশনা
এখানে তালাক সংক্রান্ত কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা এবং আল কুরআনের সঠিক নির্দেশনা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:
- তালাক কেবল শব্দ উচ্চারণ নয়, একটি প্রক্রিয়া: প্রচলিত ধারণা হলো, ‘তালাক’ শব্দটি উচ্চারণের সাথে সাথেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। কিন্তু কুরআনের বিধান অনুযায়ী তালাকের সাথে সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ হয় না। বরং এটি বিবাহ বিচ্ছেদের একটি সুনির্দিষ্ট আইনগত প্রক্রিয়ার সূচনা। হঠকারী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দ্রুত বিবাহ বিচ্ছেদকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তালাক কার্যকর করতে হলে ইদ্দাতের (সুনির্দিষ্ট অপেক্ষার সময়) শর্ত পূরণ করতে হয়। ইদ্দাত অতিবাহিত হবার পর বিবাহ বিচ্ছেদ কার্যকর হয়, যাকে ‘মুফারাক্বাত’ বলা হয়।
- ‘তিন তালাক’ এর সঠিক ব্যাখ্যা: আমাদের সমাজে ‘তিন তালাক’ শব্দটি অত্যন্ত পরিচিত। অথচ কুরআনে স্বাভাবিক তালাকের সংখ্যা হিসেবে ‘আত তালাক্বু মাররাতান’ বা ‘তালাক দুইবার’ কথাটি বলা হয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে, স্বামী দুইবার তালাক উচ্চারণ করবে। বরং এর দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে, স্বাভাবিক তালাক দুই দফায় দেওয়া যেতে পারে, যার প্রতিবারই ইদ্দাতকালে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে সম্মত হলে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার এবং পুনর্বিবাহের সুযোগ থাকে। এরপর তৃতীয়বার তালাক হচ্ছে একটি অস্বাভাবিক তালাক, যার পর বিশেষ শর্ত পূরণ (অর্থাৎ তালাকপ্রাপ্তা নারীর অন্য পুরুষের সাথে বিয়ে ও তার সাথেও স্বাভাবিক বিবাহ বিচ্ছেদ) ছাড়া তালাকপ্রাপ্তাকে ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে না।
- তালাকের পূর্বে মীমাংসার উদ্যোগ ও সালিশদার: তালাক নিছক শব্দ উচ্চারণের বিষয় নয়, বরং তালাক হচ্ছে একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া যা দুজন ন্যায়পরায়ণ সাক্ষী রেখে এবং ইদ্দাতের বিধি-বিধানের দিকে লক্ষ্য রেখে কার্যকর করতে হয়। শুধু তাই নয়, তালাকের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার আগে দাম্পত্য কলহ মীমাংসার উদ্দেশ্যে স্বামীর পরিবারের একজন এবং স্ত্রীর পরিবারের একজন বিচক্ষণ সালিশদার নিযুক্ত করতে হবে (সূরা নিসা ৪:৩৫)। যদি তারা উভয়ে (স্বামী-স্ত্রী) সংশোধনের মনবৃত্তি রাখে, তাহলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মিলন তৈরি হওয়ার তাওফিক দিবেন।
- একবার তালাক উচ্চারণই যথেষ্ট: অনেক সময় মনে করা হয় যে, তালাক কার্যকর করতে দুইবার বা তিনবার তালাক উচ্চারণ করতে হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একবার তালাক উচ্চারণ করলেই তালাকের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় এবং ইদ্দাত শেষে বিবাহ বিচ্ছেদ সম্পন্ন হয়। ‘স্বাভাবিক তালাক দুইবার’ কথাটির অর্থ দুইবার তালাক দিতে হবে এমন নয়, বরং এর দ্বারা ইদ্দাতকালের মধ্যে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের সুযোগ বোঝানো হয়।
- প্রচলিত হিল্লা বিয়ে একটি কুরআন পরিপন্থী কুপ্রথা: প্রচলিত হিল্লা বিয়ে একটি কুরআন পরিপন্থী কুপ্রথা। এর মাধ্যমে আল্লাহর আয়াতকে হাসি-তামাশার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে এবং এটি কুরআনের একটি আয়াতের অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহার মাত্র। আল কুরআন অনুসারে প্রচলিত হিল্লা বিয়ে সম্পূর্ণ অবৈধ।
- ইদ্দাতকালীন স্ত্রীর অধিকার: ইদ্দাতকালে স্ত্রীকে স্বামীর সমান মানসম্পন্ন গৃহে রাখতে হবে, সাধ্যমতো স্ত্রীর ভরণপোষণ দিতে হবে, এবং স্ত্রীকে দেওয়া দেনমোহরের কোনো অংশ ফেরত নেওয়া যাবে না (সূরা নিসা ৪:২০)। ইদ্দাত শেষে স্ত্রীকে উত্তমভাবে ও সাধ্যমতো কিছু ভোগসামগ্রী দিয়ে বিদায় দিতে হবে। এমনকি, বিয়ের পর স্ত্রীকে স্পর্শ করার আগে তালাক দিলেও তার ইদ্দাত না থাকলেও তাকে ভোগসামগ্রী দিয়ে সুন্দরভাবে বিদায় দিতে হবে।
- স্ত্রীর তালাকের অধিকার ও ‘খোলা’: ইসলামে স্ত্রীরও তালাকের অধিকার রয়েছে। স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ চাইতে পারে, যা প্রচলিত সমাজে ‘খোলা তালাক’ (Khul’) নামে পরিচিত। সেক্ষেত্রে স্ত্রী ফিদইয়াস্বরূপ দেনমোহরের কিছু অংশ ফেরত দিতে পারে। এছাড়া, স্বামী যদি স্ত্রীর স্পষ্ট অশ্লীলতার অভিযোগের ভিত্তিতে তালাক দেয়, তবে সেক্ষেত্রেও দেনমোহরের কিছু অংশ ফেরত পেতে পারে। তবে, এক্ষেত্রে কোনো স্বামী যেন নিজ স্ত্রীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষী দাঁড় করিয়ে অপবাদ দিয়ে পাপী না হয়, সে জন্য কুরআন কঠোরভাবে সতর্ক করেছে (সূরা নিসা ৪:১৯)।
- ‘ওয়াদরিবূহুন্না’ এর সঠিক বিশ্লেষণ: কুরআনে পারিবারিক সহিংসতার কোন স্থান নেই। তালাক সম্পর্কিত আয়াতে ব্যবহৃত ‘ওয়াদরিবূহুন্না’ (তাদেরকে দরবুন করো) এর প্রচলিত অর্থ ‘আঘাত’ বা ‘মৃদু আঘাত করা’ এখানকার প্রেক্ষাপট এবং আইনী প্রয়োগের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। গভীর বিশ্লেষণে দেখা যায়, ‘ওয়াদরিবূহুন্না’ অর্থ ‘তাদেরকে আঘাত/প্রহার করো’ হতে পারে না। বরং সাধারণভাবে কোনো ব্যক্তিকে ‘দরাবা’ করার অর্থ হচ্ছে তাকে বা তার সাথে সম্পর্কিত বিষয়কে সামনে উপস্থাপন করা (যেমন আদালতে উপস্থাপন করা)। অর্থাৎ, স্ত্রীর পক্ষ থেকে দাম্পত্য চুক্তি লংঘনের (যেমন স্পষ্ট অশ্লীলতার) অভিযোগ থাকলে তা আদালতে উপস্থাপন করতে হবে, পুরুষ নিজে বিচারক হয়ে দৈহিক দণ্ড কার্যকর করতে পারবে না।
- ‘যিহার’ কে অবৈধ করা: ‘যিহার’ (স্বীয় স্ত্রীকে মায়ের সাথে তুলনা করে স্ত্রী হিসেবে অস্বীকার করা) কে অবৈধ করার মাধ্যমে কার্যত হঠকারী আচরণস্বরূপ কেবলমাত্র মুখে উচ্চারণ করে তালাক কার্যকরের যেকোনো প্রচলন অবৈধ করা হয়েছে। এটি বৈবাহিক জীবনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে যথাযথ প্রক্রিয়া, নিয়মানুবর্তিতা ও আনুষঙ্গিক বিবেচনা ব্যতীত কেবল মুখের কথায় বিচ্ছিন্নকরণের প্রথাকে অগ্রহণযোগ্য প্রমাণ করে।
- লিআনের শিক্ষা ও নারীর সুরক্ষা: ‘লিআন’ (মিথ্যা ব্যভিচারের অভিযোগ থেকে পবিত্রতা ঘোষণার শপথ) এর শিক্ষা এই যে, স্বামী তার স্ত্রীকে ব্যভিচারের দায়ে দায়ী করলে এবং সাক্ষী না থাকলে, স্ত্রীর সাক্ষ্যই অগ্রাধিকার পাবে। কুরআনে তালাকের সকল বিধানে নারীর কল্যাণ ও অধিকারকে সর্বাবস্থায় অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, এমনকি মিথ্যা অভিযোগের ক্ষেত্রেও নারীর সাক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে নারীর অধিকারকে অগ্রগণ্য প্রমাণ করা হয়েছে।
ইদ্দাতের বিস্তারিত বিধি-বিধান:
তালাক কার্যকরের অন্যতম প্রধান শর্ত হলো ‘ইদ্দাত’ বা সুনির্দিষ্ট অপেক্ষার সময়কাল পূর্ণ করা। এই ইদ্দাতকাল বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন হতে পারে এবং এটি তালাক কার্যকর হওয়ার প্রক্রিয়াকে নিশ্চিত করে:
- অগর্ভবতী তালাকপ্রাপ্তা নারীর জন্য: তিনটি পূর্ণ ঋতুস্রাব (কুরু) পর্যন্ত।
- গর্ভবতী নারীর ইদ্দাত: সন্তান প্রসব পর্যন্ত।
- বিধবার ইদ্দাতকাল: ৪ মাস ১০ দিন।
- অস্পর্শকৃত স্ত্রীর জন্য: যদি স্ত্রীকে স্পর্শ করার আগে তালাক দেওয়া হয়, তবে তার জন্য কোনো ইদ্দাত নেই।
কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী, ‘ইদ্দাতের শর্ত পূরণ করে তালাক’ মানে হলো এমন সময়ে তালাক দিতে হবে যাতে ইদ্দাত সঠিকভাবে গণনা করা যায়। তাই ঋতুস্রাব অবস্থায় তালাক দেওয়া যাবে না, বরং ‘তুহর’ (পরিচ্ছন্ন) অবস্থায় তালাক দিতে হবে।
তালাক পরবর্তীতে সন্তানের কল্যাণ ব্যবস্থাপনা:
তালাকের পরও সন্তানের অধিকার ও কল্যাণকে কুরআন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। দুগ্ধপোষ্য সন্তানের দুধপানের পূর্ণ মেয়াদ দুই বছর। এই সময়ে যদি মা শিশুকে দুধপান করান, তবে শিশুর বাবার দায়িত্ব হলো মায়ের ভরণপোষণ বহন করা। যদি শিশুর বাবা মারা যান, তবে এই দায়িত্ব তার অন্যান্য উত্তরাধিকারীদের উপর বর্তাবে। এক্ষেত্রে পারস্পরিক পরামর্শের মাধ্যমে বা একমত না হলে দুধমা নিযুক্তির সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এবং দুধমার ভরণপোষণ ও পারিশ্রমিকের দায়িত্বও শিশুর বাবার। কুরআনের এই বিধানগুলো সন্তানের সর্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিত করে।
কুরআনের বিধান মানার অপরিহার্যতা
তালাক একটি চরম ও অপছন্দনীয় সিদ্ধান্ত হলেও, ইসলাম এতে একটি সম্মানজনক এবং ন্যায়ানুগ পথ বাতলে দিয়েছে, যাতে উভয় পক্ষের অধিকার সুরক্ষিত থাকে এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়। এই ব্লগ পোস্টের মাধ্যমে আমরা আল কুরআনের আলোকে তালাক সংক্রান্ত বিধি-বিধানের গভীরতা ও প্রজ্ঞা সম্পর্কে জানতে পারলাম। প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো পরিহার করে কুরআনের এই শাশ্বত বিধানগুলো অনুসরণ করা আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। আল্লাহর বিধান মেনে চলার মাধ্যমেই আমরা ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি লাভ করতে পারি।